TwitterFacebook

চৌধুরী মুঈনউদ্দিনের একান্ত সাফাই সাক্ষাৎকার : বিভ্রান্তির প্রশ্নহীন প্রচার

এ বছর শীত একটু দেরীতে আসলেও নভেম্বর মাসের শেষের দিকে এসে এখন বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। সেই শীতকে উপেক্ষা করে গণতন্ত্রের পীঠস্থান ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে একে একে সমবেত হয়েছিলেন আজ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে থাকা ১৯৭১ এর বিচারপ্রার্থী মানুষেরা। ৭৫টি প্রগতিশীল সংগঠনের মোর্চা ‘আইসিটি সাপোর্ট ফোরাম’ এর ডাকে সাড়া দিয়ে আজ সবাই একত্রিত হয়েছিলেন একটিমাত্র দাবীকে তুলে ধরতে, আর তা হল – আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে দোষী সাব্যস্ত এবং সাজাপ্রাপ্ত পলাতক যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মুঈনউদ্দিনকে যেন অবিলম্বে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এই পোস্টটির বিষয়বস্তু আজকের সমাবেশ নিয়ে নয়, চৌধুরী মুঈনউদ্দিন নিয়ে।

১৯৭১ এর ইতিহাস জানেন এমন কারও কাছেই আল-বদর কমানড্ার মুঈনউদ্দিনের বুদ্ধীজীবি হত্যাকান্ডে সরাসরি ভূমিকার কথা অজ্ঞাত নয় তাই সে পূনরাবৃত্তিমূলক আলোচনায় এখন যাচ্ছি না। আরও একটি কারণেও সে আলোচনা এখন নিষ্প্রয়োজন, আর তা হল – মুঈনউদ্দিনের অপরাধের বিষয়গুলো এখন আর কেবল ‘কথিত’ কিংবা ‘অভিযোগ’ এর পর্যায়ে নেই; আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে ভিকটিম পরিবারের সদস্যদের এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যে এখন তা আইনগতভাবেও প্রমাণিত সত্যে পরিণত হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, সাক্ষী নিজে যদি প্রত্যক্ষদর্শী হন, তাহলে তার সাক্ষ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আর সে প্রত্যক্ষদর্শী যদি নিজেও ভিকটিম হন, তাহলে সে সাক্ষ্যের গুরুত্ব আর সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়, যা মুঈনউদ্দিনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে ঘটেছে। মুঈনউদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলায় যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাদের মধ্যে এমন সরাসরি প্রত্যক্ষদর্শী ভিকটিম সাক্ষীও রয়েছেন (সূত্র: এখানে এবং ট্রাইবুনালের রায় দ্রষ্টব্য)। এই পোস্টটি মুঈনুদ্দিনকে বাংলাদেশে হস্তান্তর সংক্রান্ত আইনী-কূটনৈতিক জটিলতা, কিংবা ব্রিটিশ প্রশাসনের দিক থেকে প্রায় দুই দশকেরও বেশী সময় ধরে নানা দেশের যুদ্ধাপরাধীদের লালন করা নিয়েও নয়। এই পোস্টের বিষয়বস্তু – লন্ডনে বিডিনিউজ২৪ প্রতিনিধি সৈয়দ নাহাস পাশার নেয়া চৌধুরী মুঈনউদ্দিনের একটি ‘এক্সক্লুসিভ’ সাক্ষাৎকার। সাফাইমূলক এই সাক্ষাৎকারটির লাইনে লাইনে মিথ্যাচার এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করবার চেষ্টা – মূলত সে কারণেই এই পোস্টটি লিখতে হচ্ছে। এই সাক্ষাৎকারটির প্রতিটি লাইন ধরে আলোচনার পরিবর্তে মূলত কয়েকটি প্রধান মিথ্যাচার এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রয়াসকে সচেতন পাঠকের কাছে তুলে ধরাটাই যথেষ্ট বলে মনে করছি।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে বিচারপ্রার্থী জনতার সমাবেশ (২৭ /১১ / ২০১৩)

১. স্বঘোষিত এক ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মহাপুরুষ’ এর অসংলগ্ন বয়ান

সাক্ষাৎকারটিতে একদিকে মুঈনউদ্দিন যেমন একের পর এক দম্ভোক্তি করে গেছেন, অন্যদিকে প্রমাণিত এবং সর্বজনবিদিত কিছু সত্যকে তার বিকৃতভাবে উপস্থাপনের চেষ্টাটাও লক্ষণীয়। একদিকে তিনি প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসের সাথে মন্তব্য করছেন – ‘বিচারক ও তাদের চ্যালাচামুণ্ডারা নিজেরা উল্টো ঝুলে পড়লেও আমাকে ঝোলাতে পারবে না’, অন্যদিকে একবার দাবী করছেন ‘আমাকে মামলার নোটিশই দেয়া হয়নি’, তো আরেকবার বলে বসছেন ‘আমার তো কোনো আইনজীবিই ছিল না’!

আবার তিনি নিজেকে একজন মুসলমান হিসেবে উল্লেখ করে অতীতের সব ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মহাপুরুষদের’ সাথে নিজেই নিজেকে দিব্যি এক কাতারে দাঁড় করিয়ে ফেলছেন, আর বলছেন – ‘হায়াৎ-মওত, জীবন-মৃত্যুর সিদ্ধান্ত জমিনে হয় না, আসমানে হয়।’ অর্থাৎ, বিধাতার যদি অভিপ্রায় হয়ে থাকে তার ফাঁসীকাষ্ঠে মৃত্যু হবে না, তাহলে কোনো শক্তিই তাকে সেখানে নিতে পারবে না। বিধাতার বিচােরর উপর মুঈনউদ্দিনের অগাধ আস্থা থাকতেই পারে, তাতে দোষের কিছু দেখি না, সমস্যা হল, তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে তাকে এই ধরাধামেই সাক্ষাৎকার দিয়ে বিভ্রান্তিমূলক অপ-প্রচার করতে হয় কেন? এই বিষয়টিও বিধাতার হাতেই ছেড়ে দিলে পারতেন হয়তো চৌধুরী মুঈনউদ্দিন। আর জীবন-মৃত্যুর সিদ্ধান্ত যদি মুঈনউদ্দিনের কথামতো ‘জমিনে না হয়ে আসমানেই’ হয়ে থাকে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে ১৯৭১ এর নিহত বুদ্ধিজীবি, ৩০ লাখ শহীদ, কিংবা ধর্ষিতা-নির্যাতিতারা তাহলে কার হাতের ভিকটিম ছিল? পাকিস্তানী মিলিটারি আর তাদের দোসর জামায়াত, শান্তি কমিটি, আল-বদর, আল-শামসদের? নাকি স্বয়ং বিধাতার? আশা করি বিষয়টি নিয়ে মুঈনউদ্দিন আরেকটু গভীরভাবে ভাববেন। বলতে বাধ্য হচ্ছি – মুঈনউদ্দিনের এই মন্তব্যগুলো চিন্তায় সংলগ্ন মানুষের লক্ষণ বহন করে না, যাই হোক তা নিয়ে আমাদের ভাবিত হওয়ার প্রয়োজন দেখি না। বরং মনোনিবেশ করা যাক এই সাফাই সাক্ষাৎকারটিতে তার প্রদত্ত বক্তব্যের অসঙ্গতিগুলোতে।

২. আদালতের সমন, ওয়ারেন্ট এবং নোটিশ বিষয়ক মিথ্যাচার

সাক্ষাৎকারে চৌধুরী মুঈনউদ্দিন দাবি করছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল নাকি কোনোদিন তার কাছে অথবা তার উকিলদের কাছে কোনো ধরনের নোটিস জারি করেনি, চেষ্টাও নাকি করেনি। এমনকি দূতাবাসের মাধ্যমে বা সরাসরি তার বা তার দেশের ঠিকানায়, কোনোভাবেই নাকি যোগাযোগ করা হয়নি।

মুঈনউদ্দিনের এই দাবী সত্য নয়।

পলাতক আসামীর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনালস) আইন ১৯৭৩ এর যে বিধি, তাই অনুসরণ করা হয়েছে চৌধুরী মুঈনউদ্দিনের ক্ষেত্রে। এখানে পলাতককে খুঁজে বের করে বাড়ি বয়ে গিয়ে নোটিশপত্র দিয়ে আসার এই আবদার একেবারেই অযৌক্তিক। সবচেয়ে বড় কথা হল – মুঈনউদ্দিন যদি নির্দোষই হয়ে থাকবেন, তাহলে তিনি নিজের সুনাম অক্ষুন্ন রাখার তাগিদেই নিজ দায়িত্বে ট্রাইবুনালের মুখোমুখি হতেন, হয় ব্যক্তিগতভাবে, নয়তো নিযুক্ত আইনী প্রতিনিধির মাধ্যমে। ট্রাইবুনালে তার বিরুদ্ধে মামলার নোটিশ বিষয়ে মুঈনউদ্দিন যা দাবী করেছেন, আসুন দেখা যাক তা আসলে কতটা ভিত্তিহীন। মুঈনউদ্দিনের মামলার রায়ের ২০-২১ অনুচ্ছেদে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-২ অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বিষয়টি তুলে ধরেছেন, যা মুঈনউদ্দিন সযত্নে তার সাক্ষাৎকারে এড়িয়ে গিয়েছেন। উদ্ধৃত করছি1:

(20) [T]he Tribunal, under Rule 29(1) of the Rules of Procedure, took cognizance of offences as mentioned in section 3(2) (a)(b)(g)(h) of the Act of 1973 and issued warrant of arrest for causing appearance of the accused persons as required under Rule 30, by its order dated 02.5.2013.

(21) Dhaka Metropolitan Police (DMP) submitted the execution report before the Tribunal stating that the accused persons could not be arrested as they have already absconded and they are learnt to have left the country since long. In this circumstance, the Tribunal, as required under Rule 31, ordered [order dated 12.5.2013] to publish a notice in two daily newspapers, one in Bangla and another in English asking the accused to appear before this Tribunal within ten (10) days from the date of publication of such notice. Accordingly notice was published in ‘The daily Janakantha’ (Bengali daily) on 14.5.2013 and in ‘The daily Star’ (English daily) on 15.5.2013. But despite publication of such notice the accused persons have not appeared before this Tribunal.

বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট। সহজভাবে বললে – চৌধুরী মুঈনউদ্দিন এবং আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে অপরাধসমূহ আমলে নেয়ার পর ট্রাইবুনাল তাদের দু’জনের বিরুদ্ধেই আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারী করে এবং সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষকে অবগত করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) আসামীদ্বয়কে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। না পেয়ে তারা ট্রাইবুনালের কাছে সেই মর্মে রিপোর্ট পেশ করে। উক্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে ট্রাইবুনাল বিধি অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করে, আর তা হল জাতীয় একটি ইংরেজী এবং বাংলা পত্রিকায় এই মামলার উম্মুক্ত নোটিশ প্রকাশ। যথারীতি ১৪ এবং ১৫ মে ২০১৩ তারিখে ট্রাইবুনালের আনুষ্ঠানিক নির্দেশক্রমে2যথাক্রমে দৈনিক জনকন্ঠ এবং The Daily Star পত্রিকায় সে নোটিশ (public notice) প্রকাশিতও হয়।

সুতরাং, আইন অনুযায়ী এর পর থেকে এই পুরো মামলার বিষয়ে চৌধুরী মুঈনউদ্দিন যথাযথভাবে অবগত বলেই ধরে নিতে হবে। এভাবে ‘নোটিশ পাইনি’ বলে আসামীদের দিক থেকে অনন্তকাল ধরে বিচার ব্যবস্থার সাথে লুকোচুরি-কানামাছি খেলার কোনো অবকাশ আইনে নেই। আর তাছাড়া, উক্ত নোটিশ প্রকাশের পূর্বাপর ইংল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন মিডিয়ায় চৌধুরী মুঈন উদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলার খবরটি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যার কয়েকটিতে তার নিযুক্ত আইনজীবি এবং তিনি নিজেও সরাসরি মন্তব্য প্রদান করেন। সুতরাং, ‘নোটিশ পাইনি তাই মামলার বিস্তারিত জানি না’ – এমন বলে বিচারের দীর্ঘ হাত এড়ানোর সুযোগ দেখছি না। কারণ, তিনি খুব ভাল করেই জানতেন যে তার বিরুদ্ধে ট্রাইবুনালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সৎসাহস এবং কান্ডজ্ঞান সম্পন্ন যে কোনো নির্দোষ মানুষ তার মোকাবিলা করেন, বিভিন্ন ছুতো নাতায় পালিয়ে বেড়ান না।

chowdhury-mueen-uddin3

৩. নোটিশ নাই, তাই আইনজীবি নাই

সাফাই সাক্ষাৎকারটিতে মুঈনউদ্দিন আরও বলার চেষ্টা করেছেন যে – যেহেতু তিনি ট্রাইবুনালের কাছ থেকে কোনো নোটিশই পাননি, সেহেতু তার পক্ষের আইনজীবি নিয়োগ করার পরিসর তৈরী হয়নি। একজন আসামী তার ন্ূ্যনতম অধিকার রক্ষার্থে আইনজীবি নিয়োগ করতে পারছেন না বা পারেননি, সেটা শুনলে যে কোনো বিবেকবান মানুষেরই হৃদয় আদ্র হবে। কিন্তু সমস্যা হল – মুঈনউদ্দিনের এই কথাটা সত্য নয়, যা উপরে একবার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আর মুঈনউদ্দিন কোনো আইনজীবিই নিয়োগ করার সুযোগ পাননি – এই দাবীটিও কি সত্যি? একটু খতিয়ে দেখা যাক।

প্রকাশিত সংবাদ থেকে আমরা দেখতে পাই – যখনই মুঈনউদ্দিনের বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট আইনী পদক্ষেপ নিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল, তার প্রতিবারই ব্যারিস্টার টোবি ক্যাডম্যান নামের এক আইনজীবি মিডিয়ার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে মুঈনউদ্দিনের পক্ষ সমর্থন করে পেশাগত মন্তব্য প্রদান করেছেন। কখনো ডেইলী মেইলপত্রিকায়, কখনো গার্ডিয়ানে, কখনো বিবিসিতে, কখনো আল-জাজিরায়। এই মন্তব্যগুলো টোবি ক্যাডম্যান কোন্ ক্ষমতাবলে করেছিলেন আসলে? মুঈনউদ্দিনের নিযুক্ত আইনজীবি হিসেবে? নাকি স্রেফ নিজের বিবেকের তাড়নায়? মজার ব্যাপার হল, ট্রাইবুনাল কর্তৃক মুঈনউদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলার পাবলিক-নোটিশ প্রদানেরও বহু আগে থেকেই টোবি ক্যাডম্যান আসলে তার আনুষ্ঠানিকভাবে নিযুক্ত আইনজীবি হিসেবে দায়িত্বপালন করে আসছেন। যেমন: দি সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক এনড্রু গিলিগানের কাছে টোবি ক্যাডম্যানের লেখা শাসানীমূলক এই চিঠিটির কথাই ধরা যাক, যেটি লেখা হয়েছিল ১৩ এপ্রিল ২০১২ তারিখে, অর্থাৎ ট্রাইবুনালের পাবলিক-নোটিশেরও এক বছর আগে। সেখানে ক্যাডম্যান সরাসরি নিজের পরিচয় দিচ্ছেন এই বলে: “Dear Mr. Gilligan, As you may be aware I am currently advising Mr. Chowdhury Mueen-Uddin and his family on this matter.”3। উক্ত চিঠিতে ক্যাডম্যান মুঈনউদ্দিনের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য অভিযোগগুলো আগে থেকেই অস্বীকার করছেন কেবল তা নয়, বরং এই চিঠি থেকে এটাও অত্যন্ত স্পষ্ট যে মুঈনউদ্দিন সম্পূর্ণভাবে অবগত তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে ঠিক কি কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বা ভবিষ্যতে নেয়া হতে পারে। তার নিযুক্ত (?) আইনজীবি ক্যাডম্যান লিখছেন4:

“If formal charges are brought, as appears to be the case in light of the comments of the investigator and the Bangladesh Minister for Law, Justice and Parliamentary Affairs, then Mr. Mueen-Uddin may consider issuing a formal response in the appropriate form.”

অর্থাৎ, যদি কখনো ট্রাইবুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয়, তাহলে, ক্যাডম্যানের ভাষায়, তার মক্কেল চৌধুরী মুঈনউদ্দিন তখন অবস্থা বুঝে এর প্রত্যুত্তর প্রদানের বিষয়টি ‘বিবেচনা করবেন’ (“may consider”)। সুতরাং, এটা স্পষ্ট যে নোটিশ না পাওয়ায় মামলা লড়া সম্ভব হয়নি, কিংবা নোটিশ না পাওয়ায় আইনজীবিও নিয়োগ করা সম্ভব হয়নি – মুঈনউদ্দিনের এই দু’টো দাবীর কোনোটিই সত্যানুগ নয়। তার বিরুদ্ধে মামলায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রত্যুত্তর দেয়া বা না দেয়ার বিষয়টি পুরোটাই আসলে ছিল মুঈনউদ্দিনের নিজের সিদ্ধান্ত, যদিও তিনি সাফাই সাক্ষাৎকারে সেটিরও দায় ট্রাইবুনালের ওপর চাপানোর প্রয়াস চালিয়েছেন। ঠিক যেভাবে তিনি টোবি ক্যাডম্যানকে নিয়োগ দিয়েছেন তার পক্ষ হয়ে লড়বার জন্য, চাইলে ঠিক একইভাবেই তিনি বাংলাদেশের আর যে কোনো আইনজীবিকেই নিয়োগ দিতে পারতেন। কিন্তু দেননি। সাক্ষাৎকারে তিনি দাবী করেছেন বর্তমান জামায়াতে ইসলামীর সাথেও তার সম্পর্ক বন্ধুত্বেরই। সুতরাং, ট্রাইবুনালে জামায়াতের আসামীদের পক্ষ নিয়ে যে আইনজীবিদের টিমটি লড়ছে, মুঈনউদ্দিন চাইলেই তাদেরকেও নিয়োগ দিতে পারতেন তার হয়ে মামলাটি লড়বার জন্য। আমি নিশ্চিত, আসামী পক্ষের আইনজীবিরা তাকে ফিরিয়ে দিতো না! আসল কথা হল – মুঈনউদ্দিন নিজে মামলাটি না লড়ার সিদ্ধান্ত নিলেও ট্রাইবুনাল আইন অনুযায়ী নিজ খরচে যোগ্য আইনজীবি নিয়োগ করে দিয়েছে মামলাটি পরিচালনার জন্য (রায়ের অনুচ্ছেদ#২১ দ্রষ্টব্য)। সুতরাং, মুঈনউদ্দিন আইনগত সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে – এমন ইঙ্গিত একেবারেই ধোপে টেকার নয় এখন।

৪. পলাতক নির্দোষ! ৪০ বছরেও মামলার অনুপস্থিতি (কল্পিত)

নিজের নির্দোষীতার পক্ষে যুক্তি হিসেবে চৌধুরী মুঈনউদ্দিন যুক্তি দেখিয়েছেন এই বলে যে দালাল আইনের আওতায় যাদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়েছিল সে তালিকায় তার নাম নেই। তিনি এটি স্পষ্ট করেননি – যদি নিজেকে নির্দোষই ভাববেন, তাহলে তিনি ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ থেকে কেন পলায়ন করেছিলেন! সৎসাহস সম্পন্ন নির্দোষ মানুষ হিসেবে দেশে থেকে বিচার প্রক্রিয়ার সম্মুখীন হয়ে সকল ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো; মামলায় সত্য বেরিয়ে আসতো, তিনিও অপবাদ এবং ‘তথাকথিত ষড়যন্ত্রমূলক অপ-প্রচার’ এর হাত থেকে চিরতরে মুক্তি পেতেন। তিনি সেটা করেননি। সম্ভবত এখানে তাৎপর্যপূর্ণ হল দালাল আইন প্রণয়নের তারিখটি। আইনটি প্রণীত হয় ১৯৭২ সালে, আর তিনি দেশ ত্যাগ করেন এর অব্যবহিত পরেই, আইনটির প্রক্রিয়া পুরোপুরিভাবে শুরু হওয়ার আগেই। দালাল আইনে বিচার করবার মতো হাজার হাজার দেশীয় ছোট বড় দালাল হাতের কাছেই থাকাতে সে আইনে পলাতকদের বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়নি – এটা তো খুবই সহজ ব্যাপার। এ থেকে কি কোনোভাবে নিজের নির্দোষিতার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানো যায়? ১৯৭৫ সালে হুট করে দালাল আইনের আওতায় বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ এবং বাতিল না হয়ে গেলে সেই আইনের আওতাতেই পলাতকদেরও বিচার শুরু হতো না তা কি হলফ করে বলা যায়?

মুঈনউদ্দিন আরও দাবী করছেন, তিনি নির্দোষ বলেই তার বিরুদ্ধে নাকি এর আগে আর কখনোই ভিকটিমরা বা তাদের পরিবারের কেউই গত ৪০ বছরেও মামলা করেননি। এই দাবীটি তিনি করেছেন মামলার এক নম্বর সাক্ষী মাসুদা বানু রত্নার সাক্ষ্যের পরিপ্রেক্ষিতে, যিনি বুদ্ধিজীবি হত্যাযজ্ঞের অন্যতম ভিকটিম অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন চৌধুরীর ভাগ্নী। এখানেও মুঈনউদ্দিনের বক্তব্য সত্য নয়। কারণ, প্রকৃত ঘটনা হল – অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন চৌধুরীর পরিবারে পক্ষ থেকে মুঈনউদ্দিনের বিরুদ্ধে অতীতেও মামলা দায়ের করা হয়েছিল। অধ্যাপক চৌধুরীর ছোট বোন ফরিদা বানু নিজেই ১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার রমনা থানায় চৌধুরী মুঈনউদ্দিন এবং আশরাফুজ্জামান খান – দু’জনের বিরুদ্ধেই এজাহার (FIR) দায়ের করেছিলেন।5 এজাহারে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ অধ্যাপক চৌধুরীর অপহরণ এবং হত্যার জন্য দু’জনের বিরুদ্ধেই অভিযোগ দায়ের করা হয়। এই এজাহারের পরিপ্রেক্ষিতে সিআইডি (Criminal Investigation Department) তার তদন্তও শুরু করে। তদন্তের রিপোর্ট, যা মন্ত্রণালয়ের কাছে পেশ করা হয় পরবর্তী ব্যবস্থাগ্রহণের জন্য, স্পষ্টভাবে অভিযুক্ত দু’জনের নামই উল্লেখ করে অধ্যাপক গিয়াসের অপহরণের হোতা হিসেবে। তখন এখনকার মতো সুনির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল ছিল না। ছিল না গণহত্যা কিংবা এ জাতীয় বুদ্ধিজীবি হত্যার সুষ্ঠু বিচার করবার মতো প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান। সর্বোপরি রাজনৈতিক পট পরিবর্তনজনিত সদিচ্ছার অভাবও এসে যুক্ত হয় – এসব নানা কারণে সিআইডি’র সেই তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ বিচার আর শুরু হয়নি। কিন্তু প্রথম সুযোগেই সেই বিচারহীনতার অবসানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বাংলাদেশে, যখনই দেশে একটি পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল এবং প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

৫. স্কাইপ ঘটনা: যুতসই বিভ্রান্তির ভাঙ্গা রেকর্ড

প্রথমেই তিনি দাবী করছেন তার বিরুদ্ধে ট্রাইবুনালের এই বিচার নাকি প্রহসনের বিচার। মূল প্রমাণ হিসেবে তিনি ‘স্কাইপ ঘটনার’ উল্লেখ করে বলছেন – সেখানে তার মামলা আদালতে আসারও বহু আগেই নাকি তাকে কি শাস্তি দেয়া যেতে পারে সে বিষয়ে বিচারক এবং অন্যান্যদের মধ্যে পূর্বালোচনার প্রমাণ রয়েছে। ‘স্কাইপ’ শব্দটি উচ্চারিত হলেই একটু কম ওয়াকিবহালদের অনেককে বিভ্রান্ত হয়ে যেতে দেখেছি, সম্ভবত যথেষ্ট তথ্যের অভাবের কারণেই। সুতরাং মুঈনউদ্দিন যে এই বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগকে হাতছাড়া করবেন না সেটা অনুমেয়। মুঈনউদ্দিন যেটা এখানে উল্লেখ করছেন না তা হল – বিচারকের ব্যক্তিগত কথোপকথনে আড়ি পাতা স্কাইপ ঘটনা ষড়যন্ত্র তো বটেই, তবে সেখানে মূল ষড়যন্ত্রকারীরা হল ঠিক মুঈনউদ্দিনের সুহৃদরাই, যারা এই বিচার প্রক্রিয়ার বিপক্ষে ছিল এবং আছে সেই শুরু থেকেই। মুঈনউদ্দিন আরও যেটি বলছেন না তা হল – কথিত সে আলোচনায় মুঈনউদ্দিনের মামলার সম্ভাব্য শাস্তি বিষয়ে আসলে কোনো আলাপই হয়নি, কারণ তা একেবারেই অবান্তর।

সবচেয়ে বড় কথা হল – কথিত এই স্কাইপের রেকর্ডিং বা একপেশে ইমেইলের কপিগুলো এতোই অসম্পূর্ণতা এবং (সম্ভাব্য) জালিয়াতির দোষে দুষ্ট যে খোদ আসামী পক্ষের আইনজীবিরাই ট্রাইবুনালে এই কপিগুলোর উৎস বা সঠিকতা বা পূর্ণাঙ্গতা বিষয়ে কোন ধরণের প্রত্যয়ন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, এমনকি ট্রাইবুনালের পক্ষ থেকে তাদের একাধিকবার এই তথাকথিত স্কাইপ তথ্য প্রমাণগুলোকে প্রত্যয়ন (authenticate) করতে বলার পরও। মিডিয়ার সামনে, কিংবা অপেক্ষাকৃত কম অবগতদের সামনে আসামী পক্ষের আইনজীবিরা যতোই কল্পকাহিনী ফেঁদে, খন্ডিত তথ্যের ততোধিক খন্ডিত ও মনগড়া অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে যতোই বিভ্রান্ত করে বেড়ান না কেন, কথিত এই সব তথ্য প্রমাণগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে আদালতে প্রত্যয়নে আসামী পক্ষের আইনজীবিদের অস্বীকৃতির বিষয়টি অত্যন্ত ইঙ্গিতবহ।

এছাড়াও, সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অনেকেরই অজানা তা হল – আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ স্ব-উদ্যোগে এবং আসামী পক্ষের দরখাস্তের ভিত্তিতে চার চারটি পৃথক প্রসিডিংয়ের মাধ্যমে কথিত স্কাইপ ঘটনাটি খতিয়ে দেখেছেন সেখানে আদৌ কোনো নিয়মের ব্যত্যয় কিংবা অবিচার হয়েছে কি না। খতিয়ে দেখে ট্রাইবুনাল নিজে সন্দেহাতীতভাবে সন্তুষ্ট হবার পরই চার চারটি পৃথক আদেশের মাধ্যমে বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তিও করেছেন। আসামীপক্ষের কথিত তথ্য-প্রমাণ নিরীক্ষন করে ট্রাইবুনাল, কিংবা এমনকি বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টও, কোনো অনিয়ম বা অবিচারের আলামত পাননি। এমনকি খোদ ইকনমিস্ট পত্রিকাও তাদের মূল প্রতিবেদনে আইসিএসএফ সদস্য ড আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সাথে বিচারক নিজামুল হকের কথোপকথন বিষয়ে স্বীকার করে নিচ্ছে: ‘We do not believe he has broken any laws and cannot be held responsible for the actions of others.’6

৬. আল-বদর সদস্যের কথিত ইস্তফা, গণহত্যায় জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার স্পষ্ট স্বীকারোক্তি

আমরা সবাই জানি, জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ‘ইসলামী ছাত্র সংঘ’ থেকেই জল্লাদ এলিট বাহিনী আল-বদর সদস্যদের রিক্রুট করা হোতো। এই ঐতিহাসিক সত্য আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের একাধিক মামলায় গৃহীত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। আগ্রহীরা সাজাপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক অপরাধী আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামান কিংবা গোলাম আযম এর মামলার রায়গুলো পড়ে দেখতে পারেন, যেখানে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে এই বিষয়ে। মুঈনউদ্দিন অবশ্য স্বীকার করছেন এক সময়কার ইসলামী ছাত্র সংঘের তিনি একজন সদস্য ছিলেন বটে, কিন্তু অস্বীকার করছেন আল-বদর বাহিনীর সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি।

Untitled-1-copyআজকে ২০১৩ সালে এসে হঠাত তিনি দাবী করছেন ২৫ মার্চের পর থেকেই পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ‘অ্যাকশনের’ বিরুদ্ধে এক রকমের প্রতিবাদ হিসেবেই নাকি তিনি তার ‘রাজনৈতিক দায়িত্বগুলো’ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। এটা নিঃসন্দেহে একটি নতুন তথ্য, কারণ, এই তথ্য তিনি ১৯৯৫ সালে চ্যানেল ফোর এর ডকুমেন্টারিটি প্রচারের পর ফলাও করে জানাননি, কিংবা এক বছর আগেও দাবী করেননি কিংবা গত ৪২ বছর, এমনকি ট্রাইবুনালে তার বিরুদ্ধে মামলাতেও বিষয়টি তার আইনজীবির মাধ্যমে উত্থাপন করেননি। উল্লেখ্য, ট্রাইবুনাল কর্তৃক নিযুক্ত মুঈনউদ্দিনের আইনজীবি তার পক্ষে এতো এতো কথা বলেছেন, অথচ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারতো যে তথ্যটি, সেই ‘ইস্তফা’ দেয়ার কথাটিই একবারের জন্যও উল্লেখ করেননি। বিস্তারিত জানতে মুঈনউদ্দিনের মামলার রায়টির পৃষ্ঠা ৪৪-৪৮ দেখুন, বিশেষ করে অনুচ্ছেদ#৩২।

যদি ধরেও নিই পদত্যাগের বিষয়ে তিনি সত্য বলছেন, তাহলে নিশ্চয়ই এই পদত্যাগের পক্ষে মুঈনউদ্দিন আরও তথ্য প্রমাণ হাজির করবেন সেটাই আমরা আশা করবো। কারণ, ইতিহাসের সত্যগুলোর বিপরীতে, প্রত্যক্ষদর্শী ভিকটিম সাক্ষীর সরাসরি সাক্ষ্যের বিপরীতে এভাবে হুট করে কিছু একটা দাবী করলেই তো আর হয় না! নিজের এই সাফাই সাক্ষাৎকারেই তিনি দাবী করেছেন বহু গুণীজন নাকি তাকে প্রতিভাবান এবং সম্ভাবনাময় সাংবাদিক বলে মনে করতেন। আমরাও সেটা মনে করতে চাই। প্রতিভাবান এবং সম্ভাবনাময় একজন সাংবাদিক হিসেবে মিডিয়ায় ‘বক্তব্যের সপক্ষে প্রমাণ’ এবং ‘সময়োচিত অস্বীকৃতি (timely denial)’ এই দু’টো বিষয়ের গুরুত্ব তো তাকে নতুন করে শেখাবার কিছু নেই। যেই পাকিস্তান বাহিনীর অনাচারে তিনি প্রতিবাদী হয়ে দলীয় দায়িত্ব থেকে ইস্তফাই দিয়ে বসতে পারলেন (তার দাবী মতে), যুদ্ধের সেই ন’মাস তাহলে তিনি একজন সৎ ও দায়িত্বশীল সাংবাদিক হিসেবে সে সব অনাচারের কথা তুলে ধরেছিলেন কি? মনে করিয়ে দিই – এই তো ক’দিন আগেই বিবিসি-কে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন – পূর্বদেশ এর মতো একটি পত্রিকার একজন ‘স্টাফ রিপোর্টার’ এর জীবন এতোটাই নাকি ব্যস্ততার যে এই দায়িত্ব পালনকালে কারও হাতেই কোনো ধরণের হত্যাযজ্ঞের অপারেশন চালানোর মতো যথেষ্ট সময় থাকার কথা না। সত্য হল – ব্যস্ত ‘স্টাফ রিপোর্টার’ চৌধুরী মুঈনউদ্দিন অন্য সব বিষয়ে রিপোর্ট করার সময় পেলেও ১৯৭১ সালে তার দেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর তাদের দেশীয় সহচরদের দ্বারা সংঘটিত ব্যাপক গণহত্যার বিষয়ে কখনো একটি রিপোর্টও করার সময় পাননি! তাহলে যুদ্ধের ন’মাস সারাদিন এতো ব্যস্ত থেকে ঠিক কি বিষয়ে তিনি রিপোর্ট লিখে যেতেন সেটা এখন সিরিয়াস গবেষণার বিষয়। প্রসঙ্গত: ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (আইসিএসএফ) এর মিডিয়া-আর্কাইভের কর্মীরা সে সময়কার সমস্ত পত্র পত্রিকা সংরক্ষণের কাজে গত চার বছর ধরেই সক্রিয়; সেই সময়কার গণহত্যা বিষয়ে তথাকথিত প্রতিবাদী চৌধুরী মুঈনউদ্দিনের এমন একটি ‘সত্যান্বেষী’ রিপোর্টও আমাদের চোখে পড়েনি।

আর তর্কের খাতিয়ে যদি ধরেও নিই সেই ন’মাস যুদ্ধকালীন সেন্সরশিপ চালু থাকায় তার পক্ষে গণহত্যা নিয়ে রিপোর্ট করা সম্ভব হয়নি, তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ, এর পর ৪২ বছরেও কি তিনি সে সব অত্যাচারের কথা বিশ্ববাসীর কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরার মতো ফুরসত পাননি? বরং আল-জাজিরাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে তাকে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে আমরা উল্টোটাই করতে দেখেছি। যেখানে সরাসরি তার নাম কেবল দেশী মিডিয়ায় নয়, এমনকি বিদেশী মিডিয়াতেও ছবিসহ তুলে ধরা হয়েছে (যেমন: নিউ ইয়র্ক টাইমসের7 রিপোর্ট) আল-বদর এর একজন জল্লাদ কমান্ডার হিসেবে, সেখানে তো তার সংঘবদ্ধ গণহত্যা থেকে নিজেকে প্রকাশ্যে বিযুক্ত করার পাশাপাশি মূল সত্য তুলে ধরাটা (বিশেষ করে ইস্তফা প্রদানের ব্যাপারটি) আরও বেশী যুক্তিযুক্ত ছিল! একজন দায়িত্বশীল সাংবাদিক এই ‘প্রয়োজনীয় অস্বীকৃতি’ (essential denial) দলিলবদ্ধ করবেন না বা সময় থাকতে অন-রেকর্ড করবেন না, তা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? আমরা তা মনে করি না।

সাফাই সাক্ষাৎকারে মুঈনউদ্দিন অবশ্য দাবী করছেন মিডিয়ার তখনকার এই সব রিপোর্টই নাকি তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক অপ-প্রচারের অংশ। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার কি দায় পড়েছে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নামার? কিংবা যে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার ‘স্টাফ রিপোর্টার’ হিসেবে নাকি তিনি যুদ্ধের ন’মাস সাংবাদিকতার গুরু দায়িত্বে প্রাণাতিপাত করেছেন বলে দাবী করেছেন – ঠিক সেই পত্রিকাতেই কেন তার বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার রিপোর্ট ফলাও করে প্রকাশিত হবে? প্রসঙ্গত: ১৯৭১ সালের ২৯ ডিসেম্বর দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকা ‘অপারেশন ইনচার্জ মুঈনুদ্দিন: এই নরঘাতককে খুঁজে বের করতেই হবে’8 শিরোনামে এই তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিল:

“বাংলাদেশের সোনার সন্তান জ্ঞান প্রদীপ সাংবাদিক শিক্ষক, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবীদের ৃনৃশংস হত্যাকান্ডের বেসামরিক নায়ক বাংলার কুসন্তানদের অন্যতম চৌধুরী মুঈনুদ্দিন আজ পলাতক। নরঘাতক হানাদার শত্রুদের এদেশী দোসর জামাতে ইসলামীর ফ্যাসিবাদী সংস্থা আল-বদর বাহিনীর অন্যান্য হত্যাকারীর মত চৌধুরী মুঈনুদ্দিন আজ আত্মগোপন করে আছে। কয়েকদিন পূর্বে জামাতে ইসলামীর ঢাকা শহর শাখার দফতর সম্পাদক আব্দুল খালেক মজুমদার ধরা পড়ে। সে যে স্বীকারোিক্ত দান করে তাতে সে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত কয়েকজনের নাম প্রকাশ করে এবং চৌধুরী মুঈনুদ্দিন ঢাকায় এই হত্যাযজ্ঞের জন্য ’অপারেশন-ইন-চার্জ’ ছিল বলে প্রকাশ করেছে”।

এখানে তার বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে নানা জনের ব্যক্তিগত ষড়যন্ত্রমূলক অপ-প্রচারের যে তত্ত্বটি মুঈনুদ্দিন সাহেব প্রচারের চেষ্টা করছেন তা কি আদৌ গ্রহণযোগ্য মনে হয়?

দলীয় রাজনৈতিক দায়িত্ব থেকে মুঈনউদ্দিনের এই তথাকথিত পদত্যাগের দাবীটি আরেকটি কারণে আগ্রহের উদ্রেক করে। পাকিস্তান বাহিনীর ‘এ্যাকশন’ এর প্রতিবাদে জনৈক চৌধুরী মুঈনউদ্দিনকেই কেন হঠাত তার রাজনৈতিক দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করতে হবে? তার বর্ণিত এই ‘রাজনৈতিক দায়িত্বগুলো’র ধরণই বা ঠিক কি ছিল যা তার বিবেককে এতখানি আহত করেছিল সেই সময়? আগ্রাসী পাকিস্তান বাহিনী আর তার নিজের তখনকার রাজনৈতিক দল ‘ইসলামী ছাত্র সংঘ’ – এই দু’য়ের মধ্যে সম্পর্কের ধরণই বা কেমন ছিল? মজার ব্যাপার হল, এখানে চৌধুরী মুঈনউদ্দিন পক্ষান্তরে আসলে নিজেই স্বীকার করে নিচ্ছেন – পাকিস্তান বাহিনীর যাবতীয় হত্যাকান্ড এবং অত্যাচারের অংশীদার ছিল জামায়াতে ইসলামী এবং এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ, যে কারণে তাকে পদত্যাগের মাধ্যমে তথাকথিত এই ‘প্রতিবাদ’ (যদি সত্যি সত্যি তিনি পদত্যাগ করে থাকতেন) কর্মটি করতে হয়েছিল। আমি জানতে আগ্রহী জামায়াতে ইসলামী কিংবা ডিফেন্স টিমের সদস্যদের এই বিষয়ে কোনো বক্তব্য আছে কি না মুঈনউদ্দিনের এমন সরাসরি স্বীকারোক্তির পরও।

পরিশেষে

বাংলাদেশের মাটিতে ১৯৭১ এর অপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে অবধি একে নিয়ে চলছে লাগাতার ষড়যন্ত্র। দেশীয় রাজনীতির অন্ধকার অংশটির প্রত্যক্ষ মদদ যেমন আছে এই বিচার প্রক্রিয়াকে বানচাল এবং প্রশ্নবিদ্ধ করার কাজে, তেমনি ভীনদেশী বেসরকারী গোয়েন্দা সংস্থা, নামী দামী লবিইং ফার্ম, পাবলিক রিলেশন্স ফার্ম, শক্তিশালী মিডিয়া হাউজ, গোটা কয়েক নামজাদা ল’ফার্ম এবং মিডিয়া হাউজও সার্বক্ষণিকভাবে সক্রিয় সুবিচার নস্যাত করার এই যৌথযজ্ঞে। পৃথিবীর যত জায়গায় আজ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার হয়েছে, কোথাও আসামী পক্ষ বা তাদের লবি এতখানি শক্তিশালী ছিল না। মহা ক্ষমতাধর হিটলারের নাজি বাহিনীও ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের আগে সম্পূর্ণ ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েছিল। মরণ কামড় দেয়ার মতো শক্তি তাদের ছিল না। অন্যদিকে ১৯৭১ এর এই আসামী চক্রটি চার দশক ধরে নিজেদের শক্তিশালী করেছে, যোগাযোগে, অর্থনীতিতে, রাজনৈতিক পেশী শক্তিতে। সেদিক থেকে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার এক অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জ, পুরো পৃথিবীর বিচারের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতেই সে কথা সত্য।

হাজার সীমাবদ্ধতার মধ্যেও চার দশকের পুরোনো অপরাধের বিচারের মতো এক অত্যন্ত দুরূহ কাজ সম্পন্ন করেছে এই দরিদ্র দেশটি, এর জনগণ, এবং এর নতুন প্রজন্মের সন্তানেরা। এ কোনো সামান্য ব্যাপার নয়। এই কর্মযজ্ঞে তাই সাংবাদিক, শিক্ষক, ছাত্র, বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু ভূমিকা রাখা প্রয়োজন সার্বিক প্রয়োজনীয়তাকে মাথায় রেখে, পুরো পরিস্থিতির ব্যাপারে সজাগ থেকে। তাই বিভিন্ন মিডিয়ায় চৌধুরী মুঈনউদ্দিনের মতো একজন প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে এ ধরণের এক তরফা, প্রশ্নহীন, সাফাইমূলক সাক্ষাৎকার কোন ধরণের কার্যকর চ্যালেঞ্জ ছাড়া এভাবে প্রচারিত হতে দেখাটা আমাদের জন্য হতাশাব্যঞ্জক। সাংবাদিকতার নিরপেক্ষতা এবং নৈতিকতার কথা বাদ দিলেও শুধুমাত্র বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবেও মুঈনউদ্দিনের দেয়া বক্তব্যগুলো সাক্ষাৎকারের সময়ই সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী জনাব সৈয়দ নাহাস পাশা যুক্তিসহ খন্ডন করে পাঠকের জন্য প্রশ্নাকারে সত্যগুলো তুলে ধরতে পারতেন। আর এই প্রয়োজনীয় যুক্তি খন্ডনটুকু করবার জন্য খুব যে ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন ছিল এমনও না। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠিত এবং সর্বজনবিদিত তথ্য দিয়ে তা খুব ভালোভাবেই করা যেতো বলে মনে করি।

তাই দেশ এবং দেশের বাইরে যত মিডিয়া এবং পত্রিকার প্রতিনিধিরা রয়েছেন, আশা করি তারা বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখবেন। কারণ, বিচারের বিরুদ্ধ শক্তিটির হাতে রয়েছে লাখো ডলারের প্রচারযন্ত্র। এর বিপরীতে আমাদের ১৯৭১ এর বিচারপ্রার্থী জনগণের সে অর্থে নিজের জীবন এবং পরিবার থেকে সময়টুকু দিয়ে সুবিচারের দাবীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া দেবার মতো আর তেমন কিছুই নেই।

রেফারেন্স ও টিকা:

  1. আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-২, প্রধান প্রসিকিউটর বনাম চৌধুরী মুঈনউদ্দিন এবং আশরাফুজ্জামান সম্পূর্ণ রায়। ডাউনলোড লিন্ক: http://bit.ly/1aYd2Di []
  2. এখানে দেখুন: Staff Correspondent, ‘War Crimes Trial: Publish ad for Mueen-Uddin’s, Ashrafuzzaman’s appearance – ICT-2 directs registrar’s office’, The Daily Star 14 May 2013. http://www.thedailystar.net/beta2/news/publish-ad-for-mueen-uddins-ashrafuzzamans-appearance/ []
  3. http://tobycadman.com/index/view/sunday_telegraph_article_by_andrew_gilligan_on_bangladesh_war_crimes_my_ful []
  4. http://tobycadman.com/index/view/sunday_telegraph_article_by_andrew_gilligan_on_bangladesh_war_crimes_my_ful []
  5. সূত্র: রমনা থানা পুলিশ মামলা নং ১১৫/১৯৯৭, তারিখ ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭. এজাহারটি দায়ের করা হয়েছিল দন্ডবিধির ১২০(বি), ৪৪৮, ৩৬৪, ৩০২, ২০১, ৩৪ এবং ১১৪ ধারাসমূহের আওতায় []
  6. The Economist, ‘Trying war crimes in Bangladesh
    The trial of the birth of a nation’, December 15 2012. URL: http://www.economist.com/news/briefing/21568349-week-chairman-bangladeshs-international-crimes-tribunal-resigned-we-explain []
  7. Fox Butterfield, ‘A Journalist is Linked to Murder of Bengalis’ New York Times, 3 January 1972 []
  8. দৈনিক পূর্বদেশ, ‘অপারেশন ইনচার্জ মুঈনুদ্দিন: এই নরঘাতককে খুঁজে বের করতেই হবে’, ২৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ []

(এই লেখাটি মুক্তাঙ্গন ব্লগ এবং বিডিনিউজ২৪ এর মতামত বিভাগেও প্রকাশিত হয়েছে)

পোস্ট কিংবা মন্তব্যে প্রকাশিত বক্তব্য কোন অবস্থাতেই আইসিএসএফ এর নিজস্ব মতামতের বা অবস্থানের পরিচায়ক নয়। বক্তব্যের দায়ভার লেখক এবং মন্তব্যকারীর নিজের। শুধুমাত্র আইসিএসএফ নামের আওতায় প্রকাশিত বক্তব্যই ব্লগের সামষ্টিক অবস্থানকে নির্দেশ করবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Comments

comments

Archive I: Media Archive

Archives news reports, opinions, editorials published in different media outlets from around the world on 1971, International Crimes Tribunal and the justice process.

Archive II: ICT Documentation

For the sake of ICT’s legacy this documentation project archives, and preserves proceeding-documents, e.g., judgments, orders, petitions, timelines.

Archive III: E-Library

Brings at fingertips academic materials in the areas of law, politics, and history to facilitate serious research on 1971, Bangladesh, ICT and international justice.

Archive IV: Memories

This archive records from memory the nine-month history of 1971 as experienced and perceived by individuals from all walks of life.