TwitterFacebook

সুখরঞ্জন বালীর খোঁজে

[প্রথমবারের মত বিডিনিউজ২৪.কমে প্রকাশিত]

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত রাজাকার দেলোয়ার হোসেইন সাঈদীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে চলমান মামলার সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীর কথিত অপহরণ নিয়ে দেশে এবং বিদেশে প্রচুর কথা হয়েছে। বালী ছিলেন সাঈদীর বিপক্ষে প্রসিকিউশনের প্রস্তাবিত ৬৮ সাক্ষীর একজন।

খুব কষ্টের ব্যাপার হল তিনি এখনও তার পরিবারের কাছে ফিরতে পারেননি। কিন্তু আমি তারও চেয়ে বেশি কষ্ট পাই যখন দেখি জামাতের আইনজীবীরা এই লোকের নামে বিভিন্ন গালগল্প ছড়ায়, তাদের সূত্র দিয়ে তথাকথিত কিছু সাংবাদিক সেটিতে রং চড়ায় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো তাতে মুগ্ধ হয়ে কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়া সেই গল্পে বিশ্বাস করে তার ভিত্তিতে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। এই কাজগুলি কি বালীকে তার পরিবারের কাছে ফেরত যেতে সাহায্য করবে? মিথ্যা দিয়ে কখনও সত্য বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়?

আমি খুঁজে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি এই অপহরণের গল্প ছড়িয়ে লোকটিকে ভারতে কীভাবে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। কেউ কেউ অবশ্য এও মনে করতে পারেন যারা অপহরণের গল্প ছড়িয়েছে তারা কোনোভাবে এর সঙ্গে জড়িত কিনা। আশা করি আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী শক্ত হাতে এদের শাস্তিবিধান করবে।

এক নজরে বালী দিনলিপি

২৭ মার্চ, ২০১২

প্রসিকিউশন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে জানায় কিছু সাক্ষীকে তারা বিভিন্ন কারণে হাজির করতে পারছে না। এই তালিকার দুই নম্বরে ছিলেন সুখরঞ্জন বালী। তার ক্ষেত্রে কারণ হিসেবে জানানো হয় যে তিনি চারমাস ধরে নিখোঁজ। প্রসিকিউশন আদালতের কাছে আবেদন করে যেন তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া বক্তব্য আদালত সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করে।

আদালত তখন জিজ্ঞেস করেছিল, আসামীপক্ষ যদি তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সাক্ষ্য যাচাই করতে না পারে তাহলে সেই সাক্ষ্যের মূল্য কী? তখন প্রসিকিউশন এটি স্বীকার করে নেয় যেহেতু যাচাই করা যাচ্ছে না, তাই তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া বক্তব্য দুর্বল সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। বালীর নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে থানায় করা জিডির কপি এ সময় আদালতের নির্দেশে নথিভুক্ত করা হয় (১)।

২৮ মার্চ, ২০১২

এ দিন আদালত প্রসিকিউশনের আবেদনের ব্যাপারে আসামীপক্ষের বক্তব্য শুনেন যেখানে বলা হয় সাক্ষীর অনুপস্থিতি প্রসিকিউশনের ব্যর্থতা। তথ্যের অভাবে বিচারপ্রক্রিয়ার ন্যায্যতা ব্যাহত হওয়ার আশংকা থাকে এবং এর পুরো সুবিধা পাবে আসামী (২)।

২৯ মার্চ, ২০১২

এ দিন আদালত এ ব্যাপারে নির্দেশ দেন যেখানে বলা হয় তদন্ত কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সুখরঞ্জন বালী ভারতে চলে গেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। তার পরিবারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৪১৮ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসের পরে আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রতিবেশিদের কাছে এ ব্যাপারে একই বক্তব্য পাওয়া গেছে এবং সব বক্তব্যের ভিডিও রেকর্ড উপস্থাপন করা হয়েছে। এই অবস্থায় তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া সাক্ষ্যই নথিভুক্ত করা হবে। একজন বিচারপতি এও মন্তব্য করেন, এই বক্তব্যগুলো দাখিলকৃত গণ্য করা হবে কিন্তু সাক্ষ্য হিসেবে গৃহীত এ রকম গণ্য করা হবে না।

৫ নভেম্বর, ২০১২

এ দিন তিনি পল্টনের একটি ভবনের নয়তলায় সাঈদীর আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করে এবং তারপর আদালতের দিকে রওনা দেন। একই দিন সাঈদীর আইনজীবীরা আদালতকে জানান, সকালবেলা বালীকে ডিবি পুলিশের তিনজন সদস্য ধরে নিয়ে গেছে। সেদিন যে তারা আদালতে বালীকে নিয়ে আসবেন এটি তারা পুলিশ কিংবা ট্রাইব্যুনাল কাউকে জানাননি (৩)। সমকালের (৪) রিপোর্ট অনুযায়ী ওইদিনই দুপুরে চিফ প্রসিকিউটর গেটে কর্তব্যরত পুলিশকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

৬ নভেম্বর, ২০১২

এই দিনে (অপহরণের অভিযোগের পরের দিনই) জামাতের আইনজীবী ব্যারিস্টার রাজ্জাক পিরোজপুর অধিবাসী জনৈক আবুল কালাম আজাদের হয়ে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে একটি হেবিয়াস কর্পাস পিটিশন দায়ের করেন যাতে বলা হয় পুলিশ বালীকে আটকে রেখেছে। তিনি বালীর ‘বন্ধু’ হিসেবে এর প্রতিকার চান।

একটি অদ্ভুত ব্যাপার হল এই পিটিশন বালীর পরিবারের কোনো সদস্য দায়ের করেননি। তিনি অবশ্য দাবি করেন পরিবারের সদস্যদের হেনস্থা করা হবে বলে তিনি এই পিটিশন করেছেন। যেখানে পুলিশ ইতোমধ্যে বালীর বাড়িতে স্বাক্ষ্য নেবার জন্য গেছে এবং পরবর্তীতে তারা জিডি করার সময় ও ঠিকানা দিয়েছে, সেখানে যদি তারা হয়রানি করতে চায়ই কীভাবে তার বাদী হওয়া সে আটকাবে সেটি কিন্তু বুঝা যাচ্ছে না। প্রমাণ হিসেবে তিনি মিথ্যা খবর প্রচারের জন্য কুখ্যাত ও নিষিদ্ধ দৈনিক আমার দেশের রিপোর্টের কপি দেন। প্রথম শ্রেণির কোনো পত্রিকার রিপোর্ট দিতে পারেননি।

৭ নভেম্বর, ২০১২

এ দিন হেবিয়াস কর্পাস পিটিশনের শুনানি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উভয় পক্ষের ঐক্যমতে ১১ তারিখ শুনানি দিন নির্ধারিত হয়।

৮ নভেম্বর, ২০১২

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম সংবাদ সম্মেলন করে জানায় বালী অপহরণের অভিযোগটি ভুয়া। তারা এও প্রশ্ন তোলেন সেদিন তো বালীর আদালতের আসার কথা ছিল না। সেই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে আরও আগে এবং তখন পর্যন্ত বালীর পরিবার, পুলিশ, প্রশাসন ও আদালত সবাই জানে তিনি নিখোঁজ। এর মধ্যে বালী সাঈদীর আইনজীবীর গাড়িতে আসেন কী করে এবং একজন নিখোঁজ ব্যক্তির খোঁজ পেলে আইন অনুযায়ী তারা তাকে পরিবার বা পুলিশের কাছে সমপর্ণ করেননি কেন (৫)?

১০ নভেম্বর, ২০১২

বালী অপহরণ সংক্রান্ত গল্পের প্রথম বোমাটি এ দিন ফাটান ডেভিড বার্গম্যান। বিতর্কিত ও আদালত কর্তৃক বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশনের জন্য সতর্কবাণীপ্রাপ্ত বিদেশি সাংবাদিক বার্গম্যান তার ব্লগে এই কথিত অপহরণের একটি বিস্তারিত গল্প প্রকাশ করেন। এর জন্য প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তিনি হাজির করেন সাঈদীর তিনজন আইনজীবী এবং দৈনিক সংগ্রামের দুই সাংবাদিককে।

আইনজীবী তিনজন হলেন মিজানুল ইসলাম, মঞ্জুর আহমদে আনসারী এবং হাসানুল বান্না সোহাগ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে নয় বরং ঢাকার একটি ব্যস্ত এলাকায় অবস্থিত। এর ভেতরে, বাইরে এবং আশেপাশে সবসময় প্রচুর লোক থাকার কথা। শুধু বিচারকাজ নিয়ে নিয়মিত রিপোর্ট করছেন এ রকম সাংবাদিকের সংখ্যাই অনেক। বেছে বেছে জামাতের এই তিন আইনজীবী কেবল সেখানে দেখলেন যে একটি অপহরণ হচ্ছে? কী অবাক করা ব্যাপার!

অবশ্য আরও লোক ছিলেন। একজন হলেন জামাতেরই দৈনিক সংগ্রামের সাংবাদিক গোলাম আজম। এই সাংবাদিক ভদ্রলোকটিরও ভাগ্যও বড়দের শীর্ষ অনলাইন স্যাটায়ার ম্যাগাজিন দৈনিক মতিকণ্ঠের ভাষায় ‘অদ্ভুত’! সেই কথিত অপহরণ চলাকালেই সেখানে মোটরসাইকেলে চড়ে এসে হাজির হন দৈনিক সংগ্রামেরই আরেক সিনিয়র সাংবাদিক শহীদুল ইসলাম! এ রকম জাদু কি জুয়েল আইচও মিলাতে পারবেন?

মোবাইলে তোলা যে তিনটি ঝাপসা ছবি ডেভিড বার্গম্যান কথিত অপহরণের গ্রহণযোগ্য প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরেছেন সেগুলি নিচে দিয়ে দিলাম।

photo-1.php-3

যারা এই লেখাটি পড়ছেন তাদের কাছে প্রশ্ন, আপনাকে আগে থেকে বলে না দিলে কখনও মাথায় আসবে যে এখানে একটি অপহরণ ঘটানো হচ্ছে?

কোনো এক রহস্যময় কারণে সেই সময় আর কোনো পত্রিকার সাংবাদিক কিছুই দেখলেন না। যে কারণে জামাতের পত্রিকা ছাড়া আর কোথাও ৬ তারিখ কেউ অপহরণ করেছে বলে জানায়নি। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাংবাদিক তানিম আহমেদ কী বলেছেন দেখুন (৬)–

“I was there at the tribunal on that day and it was the first day that the prosecution was scheduled to begin closing arguments in the Sayedee case. I had reached the tribunal at 9:45am and I walked around the premises. I had been in and out and finally came in through the gates at 10:20am from where the witness was allegedly taken away barely five minutes before, around 10:15am. I personally did not see anything unusual and having asked other people, could only find two persons who claimed to have seen the car that allegedly took away the witness. Both of them were reporters of Sangram, which is affiliated with the Jamaat-e-Islami. Other than the defence lawyers and these two, there were no other witnesses. Doesn’t that strike you as very unusual?”

তার উপর ঘটনা ঘটার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ডেপুটি রেজিস্ট্রার সেখানে উপস্থিত হন, জামাতের আইনজীবীদের সঙ্গে তাদের দেখাও হয়। কিন্তু তাদের কেউ বা উপস্থিত অন্য কেউ তাকে তখন সেটি জানাননি। প্রশ্ন হল কেন?

১১ নভেম্বর, ২০১২

এ দিন হাইকোর্টের সেই বেঞ্চে দুই পক্ষের মধ্যে (ব্যারিস্টার রাজ্জাক এবং অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের টিম) যুক্তিতর্ক হয় কেন হেবিয়াস কর্পাস পিটিশনটি গ্রহণ করা হবে বা হবে না। বিচারক জানান ১৩ তারিখ রায় দেওয়া হবে।

১৩ নভেম্বর, ২০১২

ব্যারিস্টার রাজ্জাক ভালো কোনো যুক্তিতর্ক না দেখাতে পারায় বিচারক এই শুনানি খারিজ করার সিদ্ধান্ত নেন। এটি টের পেয়ে তখন ব্যারিস্টার রাজ্জাক আবেদনটি প্রত্যাহার করার অনুমতি প্রার্থনা করেন। এই হেবিয়াস কর্পাস শুনানি চলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকার্যের সমান্তরালে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে।

২৪ নভেম্বর, ২০১২

বালী অপহরণ সংক্রান্ত গল্পের দ্বিতীয় বোমাটিও ডেভিড বার্গম্যানই ফাটালেন এ দিন। আগের সপ্তাহের ছুটির দিনে তিনি বালীর গ্রামের বাড়ি গিয়ে হাজির। চলুন দেখি তিনি কী কী খবর বের করতে পারলেন (৭)। প্রথমে তিনি জানতে পারলেন একজন লোক সাদা কাগজে বালীর স্ত্রীর স্বাক্ষর নিতে এসেছিল।

তার মতে, ইনি খুব সম্ভবত থানার দারোগা। যেভাবে বালীর স্ত্রীকে দারোগার দাড়িগোঁফের কথা জিজ্ঞেস করলেন তাতে আমি ভেবেছিলাম বার্গম্যান কষ্ট করে থানায় গিয়ে মোবাইল দিয়ে ছবি তুলে আমাদেরকে মিলিয়ে দেখাবেন। কিন্তু তিনি সেটি করেননি। তবে যে ব্যাপারটি তার সাক্ষাৎকারে পাওয়া গেল সেটি হল বালীর ভারতে নিয়মিত যাওয়া-আসা আছে। শুধু তাই নয়, তার স্ত্রীর ধারণা ভাই অসুস্থ বলে বালী তাকে ভারতে দেখতে গিয়েছিল।

এ দিন বার্গম্যান আরও একটি ছোট বোমা ফাটান। তিনি জানান অপহরণের আগের দিন সাঈদীর আইনজীবী হাসানুল বান্না সোহাগ অতীশ সেন ছদ্মনামে বালীকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে গিয়েছিল। একটি প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজে পাই না। যেখানে প্রমাণের দায়ভার প্রসিকিউশনের উপর, আসামীপক্ষের উপর নয়– যেখানে আদালত একমত হয়েছে বালীকে যেহেতু পাওয়া যাচ্ছে না কাজেই তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া তার বক্তব্য দুর্বল সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হবে– যেখানে সাক্ষ্যগ্রহণ ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে– সেখানে নভেম্বরের ৪ তারিখে কেন বালীকে ছদ্মনামে ট্রাইব্যুনালে নিতে হল কিংবা কেনই-বা ৫ তারিখ যেদিন তার সাক্ষ্য দেওয়ার কোনো নির্ধারিত তারিখ ছিল না সেদিন তাকে ট্রাইব্যুনালে নিতে হল?

তাছাড়া একজন অপহৃত ব্যক্তির খোঁজ পাওয়ার প্রথম অধিকার তার পরিবারের এবং দ্বিতীয় অধিকার সেই থানার যেখানে তার নিখোঁজ হওয়ার তথ্য জিডি করে রাখা হয়েছে। জামাতের আইনজীবী যদি মিথ্যা নামে তাকে ট্রাইব্যুনালে ঢুকায় তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু আইনের উপর পড়াশোনা করা ‘স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানের’ বিদেশি সাংবাদিক সেই তথ্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে কাজটি কি ঠিক করলেন?

প্রথমত, একজন নিখোঁজ ব্যক্তির খোঁজ পাওয়ার পরও পুলিশের কাছ থেকে চেপে গেলেন। আবার মিথ্যা পরিচয়ে অনুপ্রবেশের খবরও আদালতের কাছ থেকে চেপে গেলেন। এরপরও ইনি বহাল তবিয়তে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করে যাচ্ছেন। দারুণ ব্যাপার!

photo-1.php-2

১৬ মে, ২০১৩

এ দিন ফাটে বালী সংক্রান্ত তৃতীয় বোমা। ঠিকই ধরেছেন, বার্গম্যানই এবারও আমাদের বোমারু সাংবাদিক। নিউ এইজ পত্রিকায় লেখা একটি রিপোর্টে তিনি নিচের তথ্যগুলি দেন (৩)।

● জুন, ২০১২

রাজাকার সাঈদীর পুত্র রফিক বিন সাঈদী বালীর বাসায় আসেন এবং বালীকে না পেয়ে ফোনে তাকে সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার প্রস্তাব দেন।

● দূর্গাপূজা (২০-২৪ অক্টোবর, ২০১২)

ঢাকায় এসে ১৫-১৬ দিন বালী রাজাকার সাঈদীর বাসায় অবস্থান করে।

● ২৩ ডিসেম্বর, ২০১২

পুলিশ বালীকে চোখ বেঁধে সীমান্তে নিয়ে বিএসএফের হাতে তুলে দেয়।

● ফেব্রুয়ারি, ২০১৩

নিউ এইজ পত্রিকা ফেব্রুয়ারি থেকেই জানত বালী ভারতের একটি কারাগারে বন্দি ও তার পরিবার তার সঙ্গে দেখাও করেছে। কিন্তু তারা প্রকাশ করেনি।

● ৩ এপ্রিল, ২০১৩

বালীকে ভারতের আদালত অবৈধ অনুপ্রবেশের জন্য ১০৫ দিনের কারাদণ্ড দেয়।

কিন্তু সমস্যা হয়ে যায় তখনই যখন বার্গম্যানের আজগুবি রিপোর্টের জারিজুরি ফাঁস করে দেয় বিবিসি বাংলার একটি প্রায় একই সময়ে প্রকাশিত হওয়া রিপোর্ট (৮) যেখানে বলা হয়েছে ভারতীয় পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে বালী জানিয়েছেন, তিনি তার ভাইকে দেখতে এসেছিলেন। তাকে অপহরণ করা হয়নি।

বিবিসি এও জানিয়েছে বালী ঘুষ দিয়ে তার এই বক্তব্য একজনের মাধ্যমে নিউ এজকে দেয়। এই রিপোর্টের পর ডেভিড বার্গম্যানের প্রতিক্রিয়া ছিল দেখার মতো। তিনি তার ব্লগে ইনিয়ে বিনিয়ে জানিয়েছেন, বালী ঘুষ দিয়ে নিউ এইজকে বক্তব্য দেননি, দিয়েছেন নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজনকে। আবার একই সঙ্গে এও বলেছেন যে তিনি নিশ্চিত যে এখানে ঘুষের লেনদেন হয়নি। কী মজার, তাই না?

দায়িত্ব নিতে অস্বীকার আর ঘুষ না দেওয়ার দৃঢ় দাবি এক সঙ্গেই করা হচ্ছে!

আরেও একটি ব্যাপার হল, বালীর স্ত্রী নিজেই বার্গম্যানকে বালীর ভারতে যাওয়ার ব্যাপারে একাধিকবার বলেছেন, কিন্তু সেই তথ্য এই রিপোর্টে বেমালুম চেপে যাওয়া হয়েছে।

দুর্বল তথ্যসূত্রের দুষ্টচক্র

যারা এতদূর পড়ে এসেছেন তাদের মনে এই প্রশ্ন জাগতেই পারে যদি তৃতীয় পক্ষ থেকে কোনো রকম তথ্যসূত্র না পাওয়া যায় তাহলে শুধুমাত্র জামাতের অসমর্থিত তথ্যসূত্র থেকেই বালীকে নিয়ে দুনিয়াজুড়ে তোলপাড় হয়ে গেল?

আসলেই এটি একটি বায়োস্কোপ। কখনও আপনার সামনে আসবে জামাতের লোক যারা রেফারেন্স দিবে ডেভিড বার্গম্যান আর মানবাধিকার সংস্থার। যখন ডেভিড বার্গম্যান আসবেন রেফারেন্স দিবেন জামাতের আইনজীবী আর দৈনিক সংগ্রামের এবং মানবাধিকার সংস্থার। আর যখন মানবাধিকার সংস্থাগুলো আপনার চোখের সামনে আসবে তখন দেখবেন তারা রেফারেন্স দিচ্ছে জামাত আর বার্গম্যানের। ব্যাপারটি দেখতে মোটামুটি এ রকম।

photo-1.php-4

উপরে ইতোমধ্যে বার্গম্যান যে তার দাবিতে জামাত আর দৈনিক সংগ্রামের বাইরে আর কোনো সূত্র দিতে পারেননি সেটি বলেছি। তাহলে এই চক্রের বাকি ব্যাপারটি কী?

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই বক্তব্যটি দেখুন (৯)। তারা দাবি করেছে আদালতে সাক্ষীরা বলেছে তারা নিজ চোখে অপহরণটি দেখেছে। তারা যেটি চেপে গেছে সেটি হল এই সাক্ষীরা আর কেউ নন, জামাতেরই আইনজীবী। আবার ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের এই সাক্ষাৎকারটি (৬) দেখুন। প্রশ্নকর্তা যখন চেপে ধরলেন এই বলে যে ঘটনার সময় তিনি নিজেও সেখানে ছিলেন কিন্তু কোনো অপহরণ ঘটতে দেখেননি, জামাতের আইনজীবী তার কোন ব্যাখ্যা না দিয়ে বলেছেন, শুধু আমরা বলেছি নাকি? ডেভিড বার্গম্যান আর হিউম্যান রাইটস ওয়াচও তো বলেছে।

মজার মিল হল, নিউ এইজ পত্রিকার জানার একমাসের মধ্যে হিউম্যান রাইটস ওয়াচও জেনে যায় বালী কলকাতায় কারাগারে আছেন, কিন্তু তাও তারা প্রকাশ করেনি। একটি বিষয় আমরা বুঝি না, তাদের দাবী অনুযায়ী নিরাপত্তার কারণে তারা তা প্রকাশ করেনি, তাহলে এখন প্রকাশ করলেন কেন? নিরাপত্তা এর মধ্যে হঠাৎ বেড়ে গেল কী করে?

কারণ তারা যখন জানে তার অনেক আগে থেকেই ভারতের থানা আর আদালতে বালীর উপস্থিতি ডকুমেন্টেড। কাজেই গায়েব করে দেওয়া সম্ভব নয়। করে দিলে সেই নথির জবাব তাদের দিতে হবে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নিজেও তাদের খবরে (১০) তথ্যসূত্র হিসেবে বাংলাদেশে কর্মরত যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে আগ্রহী একজন ইনডিপেনডেন্ট জার্নালিস্টের কথা বলেছে–

এ তল্লাটে এ রকম কিন্তু একজনই আছে! একইভাবে বিবিসি যখন বার্গম্যানের জারিজুরি ফাঁস করে দিল তখন তিনি নিজেই ঘ্যানঘ্যান করেছেন কেন বিবিসি বলছে না যে শুধু তিনি নন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচও তো একই প্রশ্ন তুলছে। এত সার্কাস রাখব কোথায় আমরা!

আরেকটি ব্যাপার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, থানায় জিডি হয়েছে, আদালতে জানানো হয়েছে– এমন সময় জানা গেল তিনি জামাতের আইনজীবীর বাসায়। কিন্তু তখন কেউ কোনো অপহরণের অভিযোগ বা সন্দেহ করলেন না। কেন?

যারা এখনও ধৈর্য ধরে পড়ে যাচ্ছেন তাদের নিশ্চয়ই এখন জানতে ইচ্ছা করছে জামাত, বার্গম্যান আর হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দুর্বল তথ্যসূত্রের দুষ্টচক্রের বাইরেও তো অনেকে অভিযোগ করছে। তাদের ব্যাপারটি তাহলে কী?

আপনারা যদি একটু খোঁজ নেন তাহলে জানতে পারবেন সব রসুনের কোয়ার গোঁড়া আসলে এক জায়গায়। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমেই আরেকজনের সঙ্গে একত্রে লেখা আরেকটি উপসম্পাদকীয়তে (১১) ব্যবহার করা একটি ছবি এখানে আবার ধার করলাম। আপনারা দেখুন কারা কারা অভিযোগ করছে এবং তাদের তথ্যসূত্রের মূল উৎসটি কী। প্রশ্নবোধক চিহ্নটি হল সেই নাম না জানা ইনডিপেনডেন্ট জার্নালিস্ট।

photo-1.php-1

কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়! তাই না?

ধন্যবাদ, ভালবাসা আর কৃতজ্ঞতা

যারা দরকারি লেখার বাইরে কিছু পড়তে চান না তারা বোধহয় এখানেই ক্ষান্ত দিতে পারেন। লেখার বাকি অংশ শুধুই ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। এ বছরের গোড়ার দিকে টানা বেশ কয়েকটি জরিপে মানুষ চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে কিছুটা হতাশ ছিল। কিন্তু গত অক্টোবরের মাঝামাঝি এমআরসি মোড-এশিয়াটিক পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, মানুষ যুদ্ধাপরাধের বিচারকে বিদ্যুৎ ও শিক্ষার পরে সরকারের তৃতীয় সাফল্য হিসেবে দেখছে।

এটি যেনতেন ব্যাপার নয়। মনে রাখতে হবে সরকারের কৃষিমন্ত্রী ছিলেন কিন্তু মতিয়া চৌধুরী। তাঁর দক্ষতা, সাফল্য ও সততা কিংবদন্তীর মতো। তাঁর অবদান ছাপিয়ে যদি যুদ্ধাপরাধের বিচার সরকারের তৃতীয় সাফল্য হয়ে যায় তাহলে অবশ্যই বিশেষ কিছু।

কয়েকদিন আগে ঢাকা ট্রিবিউনের একটি জরিপও বলল তিন চতুর্থাংশ মানুষ যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে সন্তুষ্ট। ২০০৯ সাল থেকে চলে আশা এই বিচার তো হঠাৎ একদিনে ভালো হয়ে যায়নি। শুরু থেকেই এটি ঠিকভাবে চলছিল। কিন্তু দেশে-বিদেশে অপপ্রচারে এটি নিয়ে মানুষের মধ্যে একটি সাময়িক বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিল।

কিন্তু শুরু থেকে চলে আসা দেশপ্রমিক মানুষ, ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, গবেষক, স্বেচ্ছাসেবক, গণআন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় অবশেষে সেই বিভ্রান্তির মেঘ কেটে গেছে। যেসব দেশি-বিদেশি ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান এই বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল তারা জেনে গেছে তারা হেরে গেছে। আর কখনওই তারা হালে পানি পাবে না।

এই প্যারাগ্রাফটি যখন লিখছি কৃতজ্ঞতায় আমার চোখে পানি চলে এসেছে। যারা এই বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন আপনাদের সবার জন্য থাকল অনেক অনেক শ্রদ্ধা আর ভালবাসা। আমরা নিশ্চয়ই আপনাদের পরিশ্রম বৃথা যেতে দিব না। এই ব্যাপারটিকে আমাদের বয়সীরা শুধু একটি সাময়িক কাজ হিসেবে নিবে না, আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ যেমন ঠিক, তেমনি এটিও তাদের জীবন ভাবনার একটি অংশ হয়ে থাকবে এই নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি।

তথ্যসূত্র:

[১] ‘আলীমের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে’, দৈনিক সমকাল, ২৮ মার্চ ২০১২

http://bit.ly/JG1V95

[২] সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ, দৈনিক সমকাল, ২৯ মার্চ ২০১২

http://bit.ly/1ieg8pI

[৩] Witness alleges state abduction, The New Age, May 16, 2013

http://bit.ly/1dtyMpb

[৪] সাঈদীর বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক শুরু, আসামিপক্ষের আদালত বর্জন, দৈনিক সমকাল, ৬ নভেম্বর ২০১২

http://bit.ly/Kw5a39

[৫] সাঈদীর বিচার বানচালের চেষ্টা করছে আসামীপক্ষ, দৈনিক সমকাল, ৯ নভেম্বর ২০১২

http://bit.ly/1cO3CYy

[৬] ‘Sabotaging? Oh no, no way’, The BDNews24.com, Jan 4th, 2013

http://bit.ly/1cWHRtZ

[৭] Exclusive: Wife of abducted witness speaks out, Bangladesh War Crimes Tribunal, November 24, 2012

http://bit.ly/1eFd3Nc

[৮] ‘নিখোঁজ’ সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীর নথিপত্রে অপহরণের কথা নেই, বিবিসি বাংলা, ১৬ মে, ২০১৩

http://bbc.in/1ieiXan

[৯] India: Protect Bangladesh War Crimes Trial Witness, Human Rights Watch, May 16, 2013

http://bit.ly/1eFdBlY

[১০] Bangladesh: Find Abducted Witness, Human Rights Watch, January 16, 2013

http://bit.ly/17evIw8

[১১] আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন: কিছু কৌতূহল, বিডিনিউজ টোয়েন্টি ফোর ডটকম, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৩

http://bit.ly/1cyUWIX

 

ওমর শেহাব: ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড, বাল্টিমোর কাউন্টিতে কম্পিউটার সায়েন্সে পিএইচ-ডি অধ্যয়নরত; সদস্য, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটিজি ফোরাম (আইসিএসএফ)।

 

পোস্ট কিংবা মন্তব্যে প্রকাশিত বক্তব্য কোন অবস্থাতেই আইসিএসএফ এর নিজস্ব মতামতের বা অবস্থানের পরিচায়ক নয়। বক্তব্যের দায়ভার লেখক এবং মন্তব্যকারীর নিজের। শুধুমাত্র আইসিএসএফ নামের আওতায় প্রকাশিত বক্তব্যই ব্লগের সামষ্টিক অবস্থানকে নির্দেশ করবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Comments

comments

Archive I: Media Archive

Archives news reports, opinions, editorials published in different media outlets from around the world on 1971, International Crimes Tribunal and the justice process.

Archive II: ICT Documentation

For the sake of ICT’s legacy this documentation project archives, and preserves proceeding-documents, e.g., judgments, orders, petitions, timelines.

Archive III: E-Library

Brings at fingertips academic materials in the areas of law, politics, and history to facilitate serious research on 1971, Bangladesh, ICT and international justice.

Archive IV: Memories

This archive records from memory the nine-month history of 1971 as experienced and perceived by individuals from all walks of life.