TwitterFacebook

মুক্তিযুদ্ধের আরও একটি ফরমায়েশি ইতিহাস

প্রথমা প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ একে খন্দকারের বই ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’। প্রকাশিত হবার পরে পরেই বইটি নিয়ে দারুণ বিতর্ক শুরু হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখালেখির প্রতি মানুষের বিশেষ করে তরুণদের আগ্রহ বেশ বেড়েছে। কাজেই একজন মুক্তিযোদ্ধা যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই স্মৃতিচারণ করেন তখন স্বাভাবিকভাবেই সেটা কৌতূহলী করে তুলবে পাঠককে। পাঠকের এই আগ্রহের কারণেই একে খন্দকারের বই নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

বই হিসেবে একে খন্দকার কিংবা প্রথমা প্রকাশনী পাঠকের সামনে কী উপস্থাপন করছেন খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে, উপজীব্য যখন মুক্তিযুদ্ধ, তখন ইতিহাসের পাঠক হিসেবেই এই বইয়ে উপস্থাপিত তথ্য ও বক্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখাটা জরুরি বলে মনে হয়। কারণ মুক্তিযোদ্ধারা যা বলে গেছেন, বলে যাচ্ছেন এবং বলে যাবেন সেইসব সাক্ষ্য থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করা হবে এবং যারা একাত্তর দেখেননি, তারা মুক্তিযুদ্ধের বিশাল ও বিস্তৃত প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে পারবেন।

সেই প্রেক্ষাপটেই ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’ বইয়ে যেসব তথ্য ও মন্তব্য উপস্থাপনা করা হয়েছে তা একটু খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি। বইয়ে যেসব বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে, তার অনেক কিছু নিয়েই কথা বলা যায়। অত দীর্ঘ না করে, এখানে প্রধান কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে।

বইয়ে যেসব বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে, তার অনেক কিছু নিয়েই কথা বলা যায়

২.

মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির ব্যাপারটা নিয়েই প্রথমে কথা বলা যাক। একে খন্দকার লিখেছেন–

“শোনা যায়, মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্ররা নিজ উদ্যোগে ৩০৩ রাইফেল দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ের মতো তখন তথ্যপ্রযুক্তি এত উন্নত ছিল না। তাই এ ধরনের কোনো তৎপরতার খবর তাৎক্ষণিকভাবে আমি বা অন্য সামরিক কর্মকর্তারা জানতে পারিনি। এর ফলে কর্মরত বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের ধারণা হয় যে, রাজনৈতিক নেতাদের কোনো ধরনের যুদ্ধপ্রস্তুতি নেই। ফলে ২৫ মার্চ ঢাকাসহ সারাদেশে যখন পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করল, তখন একে প্রতিহত করার জন্য বাঙালি সেনাসদস্যদের কোনো প্রস্তুতি ছিল না।’’

এখানে প্রথমেই যে জিনিসটি দৃষ্টিকটুভাবে চোখে পড়ে সেটা হল, অনুচ্ছেদের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের যুদ্ধপ্রস্তুতি সম্পর্কে বলা কথাটির আগে জুড়ে দেওয়া দুটি শব্দ-– ‘শোনা যায়’। মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ একে খন্দকার স্বাধীনতার তেতাল্লিশ বছর পরে এসেও নিশ্চিতভাবে জানেন না যে, দেশের ছাত্ররা সেইদিন সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল! এর কাছে ওর কাছে যা শুনেছেন, তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রস্তুতি ছাড়া আর কোনো খবর তিনি জানতে পারেননি! একে সম্ভবত অবজ্ঞা বলে। এই অবজ্ঞার দৃষ্টান্ত এর পরেও তিনি রেখেছেন। সে কথায় আমরা পরে ফিরে আসব।

অন্য এক জায়গায় একে খন্দকার বলেছেন, যদি আওয়ামী লীগ নেতাদের কোনো যুদ্ধ পরিকল্পনা থাকত, তাহলে মার্চের শুরু থেকে জনগণ, বেসরকারি ও সামরিক কর্মকর্তাদের স্বল্প সময়ে সঠিকভাবে সংগঠিত করা যেত।

যাহোক, উপরের দুটি অনুচ্ছেদ থেকে তিনটি সারকথা বের করে আনা যায়।

প্রথমত, বেসামরিক জনগণের তেমন কোনো যুদ্ধপ্রস্তুতি ছিল না; যা ছিল সেটা সামরিক কর্মকর্তারা জানতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, এই না জানার কারণে সেনাসদস্যরাও কোনো ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখেননি। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বেসামরিক জনগণ এবং সেনাসদস্যদের মধ্যে কোনো ধরনের সমন্বয় ছিল না।

তিনটির কোনোটিই সত্য নয়।

‘১৯৭১ উত্তর রণাঙ্গনে বিজয়’ বইটি লিখেছেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান মণ্ডল। সেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, উত্তরবঙ্গে আখতারুজ্জামানরা একাত্তরের মার্চের শুরু নয়, ফেব্রুয়ারি থেকেই সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছেন এবং মোটামুটি সাফল্যের সঙ্গে ইপিআর বাহিনীর সঙ্গেও সমন্বয় সাধনের কাজটি সেরে ফেলেছেন।

আখতারুজ্জামান মণ্ডলের বই থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু গোপনে স্বাধীনতার জন্য কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই নির্দেশ ছাত্রনেতাদের মাধ্যমে আখতারুজ্জামান মণ্ডল ও তার সঙ্গীদের কাছে পৌঁছেছে এবং সেই নির্দেশ অনুসারেই তারা একাত্তরের ফেব্রুয়ারিতেই কুড়িগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসহ উত্তরবঙ্গের একটি বড় অংশে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। গোপনে কন্ট্রোল রুম স্থাপন এবং ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সমন্বয় সাধনের কাজও করেছেন। [১]

যার ন্যূনতম বিবেচনাবোধ আছে, তিনি আখতারুজ্জামান মণ্ডলের বিবরণ থেকেই বুঝবেন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মোটেই অপ্রস্তুত ছিলেন না, বেসামরিক জনগণকে সংগঠিত করার জন্য তাঁদের পরিকল্পনাও ছিল।

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মোটেই অপ্রস্তুত ছিলেন না, বেসামরিক জনগণকে সংগঠিত করার জন্য তাঁদের পরিকল্পনাও ছিল

সেনাসদস্যদের সঙ্গেও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সিভিলিয়ান জনগণের একাংশের যোগাযোগ ছিল, বেশ ভালোভাবেই ছিল। এর বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের লেখা A Tale of Millions বইতে। রফিকুল ইসলামের জবানি থেকে জানা আচ্ছে, মার্চের মাঝামাঝি সময়েই তিনি প্রায় ৬০০ ইপিআর সদস্যকে চট্টগ্রামে সংগঠিত ও প্রস্তুত করে রেখেছেন এবং সীমান্ত এলাকা থেকে আরও ৯০০ সদস্য তার পরিকল্পনায় যোগ দেবেন, সেটিও স্থির করেছেন। ঢাকায় কর্মরত জ্যেষ্ঠতম বাঙালি সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তিনি জনৈক দেলওয়ারকে দায়িত্ব দিয়েছেন। চট্টগ্রামে থাকা বাঙালি সেনা অফিসার, যাদের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন তারা পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিতে প্রস্তুত। [২]

একই বইতে রফিকুল ইসলাম আরও লিখেছেন, তিনি নিজে বঙ্গবন্ধু এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন প্রস্তুতির ব্যাপারে। রফিকুল ইসলাম এ-ও জানাচ্ছেন, বাঙালি সেনাসদস্যদের একটি অংশ মার্চের দ্বিতীয়াংশে এসেও বিশ্বাস করেননি যে আসলেই একটি যুদ্ধ হতে যাচ্ছে, বাঙালি অফিসারদের যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত বলেই এই অংশটি মনে করেননি তখনও-–

Although the officers agreed with me on the issue of the military build-up, they could not make up their mind whether the situation demanded any military action on our part or not.

একে খন্দকার যেভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপরে দায়ভার চাপিয়ে দিয়েছেন এবং সামরিক কর্মকর্তাদের সংগঠিত করায় ব্যর্থতার কথা বারবার বলছেন, তার প্রেক্ষিতে এই শেষের অংশটুকু গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতেই হয় বৈকি!

যাহোক, আখতারুজ্জামান মণ্ডল এবং রফিকুল ইসলামের বিবরণ থেকে এই তিনটি বিষয় পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে–

১. বাঙালি সেনাসদস্যরা পরিস্থিতির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, তারা একেবারে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতিহীন অবস্থান ছিলেন না;

২. বেসামরিক জনসাধারণ তাদের সাধ্যমতো সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলেন;

৩. রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ হাত গুটিয়ে বসে ছিলেন না, সেনাসদস্য ও বেসামরিক জনগণের সঙ্গে তাদের মোটামুটি ভালো রকম সমন্বয় ছিল, যুদ্ধের প্রস্তুতির ব্যাপারটিও মোটামুটিভাবে মনিটরিং করা হচ্ছিল।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই প্রস্তুতির মাত্রা কী রকম ছিল? সারা দেশের প্রত্যেকটি মানুষ এর সঙ্গে জড়িত ছিল, এমন নির্বোধের মতো দাবি অবশ্যই কেউ করবেন না। সেই সময়ে চারপাশেই বিশ্বাসঘাতকদের আনাগোনা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দারাও বসে ছিল না। সতর্কভাবে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের দিকে চোখ রাখছে তারা। সেনানিবাস থেকে বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন এবং খবর সংগ্রহ কতটা কঠিন ছিল তার খানিকটা নমুনা পাওয়া যাচ্ছে জহিরুল ইসলামের লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দার ও তার বিয়োগান্ত বিদায়’ বইয়ে।

এই বইয়ের বিবরণ অনুযায়ী, সেনানিবাসের অবস্থা তখন খুবই উত্তেজনাপূর্ণ, কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাঙালি সেনা ও অফিসারদের সেনানিবাস থেকে বের হওয়া নিষেধ। ঢাকায় কী ঘটছে, দেশে কী ঘটছে, সেটা ক্যান্টনমেন্টের ভেতর থেকে জানা বেশ কঠিন। এক সন্ধ্যায় লুকিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে, মতিঝিলে বোনের বাসায় যান মেজর হায়দার এবং ফেরার সময় প্রহরির হাতে ধরা পড়েন। শেষ পর্যন্ত তার পিঠে বন্দুক ঠেকিয়ে তাঁবুতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। [৩]

এই ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে কমবেশি সকল বাঙালি সৈনিক পড়েছেন বলেই ধরে নেওয়া যায়। এইসবের প্রতিবন্ধকতা পার হওয়ার পরে, যেটুকু প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল সেটাকে অন্তত ‘শোনা যায়’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই।

এখানে উদ্ধৃত অংশে একে খন্দকার যা বলেছেন, সেটা অজ্ঞতা থেকে বলে থাকতে পারেন, অবজ্ঞা থেকেও পারেন, অন্য কোনো কারণেও পারেন। কারণটি কী সেই সিদ্ধান্তে না গিয়ে বরং আমরা এটুকু নিশ্চিত হয়ে থাকি, একে খন্দকার যা লিখেছেন তা সত্য নয়।

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিশেষ করে শেখ মুজিব যুদ্ধের ব্যাপারে কী প্রস্তুতি নিয়েছিলেন সেই বিষয়ে আরও কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা পরে করা হবে।

৩.

একে খন্দকার লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণেই যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল সেটা তার মনে হয় না। এই ভাষণের শেষে বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন।

প্রথমে ‘জয় পাকিস্তান’ বলার বিষয়টির মীমাংসা করা যাক। এটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি জনপ্রিয় কিন্তু অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক। একে খন্দকারই প্রথম ব্যক্তি নন, যিনি এই দাবি করেছেন। এর আগে শামসুর রাহমান এবং আহমদ ছফাও এমন কথা বলেছেন। আহমেদ ছফা যে প্রবন্ধে বলেছেন (১৯৭১: মহাসিন্ধুর কল্লোল), সেখানে আবার জুড়ে দিয়েছেন, তার শ্রুতিবিভ্রম হতে পারে। পারে বটে! প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁরা কি সত্য বলেছেন?

এই দাবি সত্য কি মিথ্যা সেই বিশ্লেষণে যাবার আগে বরং এর বিপরীত মতগুলোর দিকে একটু তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করি। আবুল মনসুর আহমেদের বিখ্যাত রচনা ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইতে এই প্রসঙ্গটি খোলাসাভাবেই আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে থেকেই উদ্ধৃত করা যাক–

‘‘যারা নিজেরা উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন বলিয়া দাবি করেন তাদের কেউ কেউ আমার এই কথার বিরোধিতা করেন। তারা বলেন, শেখ মুজিব ৭ মার্চের সভাতেও ‘জয় বাংলা’, ‘জয় পাকিস্তান’ বলিয়া বক্তব্য শেষ করিয়াছিলেন। আমি যখন বলি যে, পরদিন আমি রেডিও-টেলিভিশনে নিজ কানে তাঁর বক্তব্য শুনিয়াছি এবং তাতে ‘জয় পাকিস্তান’ ছিল না, তার জবাবে তারা বলেন, পরদিন রেকর্ড ব্রডকাস্ট করিবার সময় ঐ কথাটা বাদ দেওয়া হইয়াছিল। যাক আমি নিজ কানে যা শুনিয়াছিলাম, তাই লিখিতেছি। বক্তৃতা শেষ করিয়াই মুজিব সভামঞ্চ ত্যাগ করিলেন। তাজুদ্দিন সাহেব মুহূর্তমাত্র সময় নষ্ট না করিয়া মাইকের স্ট্যান্ড চাপিয়া ধরিলেন এবং বলিলেন: ‘এইবার মাওলানা তর্কবাগীশ মোনাজাত করিবেন। সভার কাজ শেষ’। মাওলানা তর্কবাগীশ মাইকের সামনে দুই হাত তুলিয়া মোনাজাত শুরু করিলেন। সমবেত বিশ-পঁচিশ লক্ষ লোকের চল্লিশ পঞ্চাশ লক্ষ হাত উঠিয়া পড়িল। মোনাজাতের সময় এবং তকবিরের সময় কথা বলিতে নাই। তাই কেউ কথা বলিলেন না। নড়িলেন না। যখন মোনাজাত শেষ হইল, তখন শেখ মুজিব চলিয়া গিয়াছেন।’’

পরদিন আমি রেডিও-টেলিভিশনে নিজ কানে তাঁর বক্তব্য শুনিয়াছি এবং তাতে ‘জয় পাকিস্তান’ ছিল না

আবুল মনসুর আহমেদের ভাষ্য থেকে জানা যাচ্ছে তিনি রেডিওতে ভাষণ শুনেছেন। একে খন্দকারও তাই শুনেছেন। আবুল মনসুর আহমেদের পরিচিত ব্যক্তি, যাদের দাবি শেখ মুজিব ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছেন, তারাও সাক্ষ্য দিচ্ছেন, রেডিওতে প্রচারিত ভাষণে ওই অংশটি কেটে দেওয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে একে খন্দকার কীভাবে শুনেছেন? এই প্রশ্নটির উত্তর একে খন্দকার দিলে অনেক জট খুলতে পারে হয়তো।

শামসুর রাহমানের আত্মজৈবনিক স্মৃতিচারণ ‘কালের ধুলোয় লেখা’। এইখানে কবি শামসুর রাহমান ‘জয় পাকিস্তান’ শ্লোগানের ব্যাপারটি বলেছেন। এই সূত্রটি অনেকেই ব্যবহার করে থাকেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, শামসুর রহমান নিজেই পরে স্বীকার করে নিয়েছেন, তার দেওয়া এই তথ্যটি ভুল। ৩০ জুলাই, ২০০৪ তারিখে সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকায় শামসুর রাহমান স্বীকার করেছেন, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে ‘জয় পাকিস্তান’ জাতীয় কোনো শ্লোগান দেননি, ‘জয় বাংলা’ বলেই সেইদিন ভাষণ শেষ করেছেন তিনি। অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটির জন্য পাঠক ও বঙ্গবন্ধুপ্রেমীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন শামসুর রাহমান।

বাংলাদেশের প্রথিতযশা ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন মাত্র ক’দিন আগেই চট্টগ্রামে একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ওইদিনের সভায় তিনি উপস্থিত ছিলেন এবং শেখ মুজিব সেদিন ‘জয় পাকিস্তান’ জাতীয় কিছু বলেননি।

এই প্রবন্ধ লিখবার আগে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে নিয়েছি, আরা সেইদিনের সভায় উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যেকেই বলেছেন, এমন কিছু তারা শোনেননি।
৭ মার্চের ভাষণের যতগুলো ফুটেজ পাওয়া গেছে, কোনোটিতেই এ রকম কোনো নমুনা পাওয়া যায় না। সত্যি সত্যি এমন কোনো ফুটেজ থাকলে সেটা বিএনপির সর্বশেষ দু’টি শাসনকালে খুঁজে পাওয়া যাবে না, তা কি বিশ্বাসযোগ্য?

এখন এই পরস্পরবিরোধী দু’টি বক্তব্যের মাঝে সত্য হিসেবে কোনটাকে ধরে নেওয়া উচিত? এর উত্তর খুব সহজ। যারা বলছেন এমন কিছু তারা শোনেননি, এখন পর্যন্ত পাওয়া সব ডকুমেন্ট ও ভিডিও ফুটেজ কিন্তু তাদের বক্তব্যই সমর্থন করে। যারা বলছেন, শেখ মুজিবকে ‘জয় পাকিস্তান’ বলতে তারা শুনেছেন, এর সত্যতা প্রমাণের দায়ভারটাও তাদের ঘাড়েই বর্তায় এবং তারা এখনও তাদের দাবির পক্ষে শক্ত কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেননি– না কোনো ভিডিও ফুটেজ, না ওই সময়ের পত্রিকায় এর উল্লেখ।

আমাদের হাতে থাকা প্রত্যক্ষ্যদর্শীর বিবরণ, ভিডিও ফুটেজ, পত্রিকার খবর কোনোটি থেকেই এমন কোনো মজবুত প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না, যা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, শেখ মুজিব ৭ মার্চ ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছেন। উলটো যাদের লেখা থেকে এই দাবি পাওয়া যাচ্ছে, তাদেরই কেউ কেউ ভুল স্বীকার করে নিয়েছেন। একে খন্দকারের এই বিভ্রান্তিকর বক্তব্যও তাই বাতিল হয়ে যাচ্ছে।

এর পরে আসছে, তিনি একে স্বাধীনতার ডাক মনে করেন কি না। তিনি কী মনে করেন বা না করেন সেটা তো পুরোপুরি তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। একই জিনিসের প্রভাব একেক মানুষের কাছে একেক রকম। সামরিক ব্যক্তিত্ব একে খন্দকারের কাছে শতভাগ বেসামরিক মুজিবের বেসামরিক ভাষণ অগুরুত্বপূর্ণ মনে হতেই পারে। তবে এই প্রবন্ধ লিখবার সময় একেবারে হাতের কাছেই অন্তত দুজন সেনাসদস্যের জবানি রয়েছে, যারা ৭ মার্চের ভাষণেই স্বাধীনতার ডাক শুনতে পেয়েছেন।

জিয়াউর রহমান তার ‘একটি জাতির জন্ম’ নিবন্ধে এই ভাষণকে চূড়ান্ত যুদ্ধের গ্রিন সিগন্যাল মনে করেছেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী তার এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন-–

“বুঝতে আমার একটুও অসুবিধা হয়নি যে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ শুধু আমাকেই উদ্বেলিত করেনি, বরং প্রতিটি বাঙালির বুকেই তুলেছে বিদ্রোহের ঝড়, স্বাধীনতার অনাস্বাদিত স্পৃহা।”

এখন একে খন্দকার যদি এই ভাষণ থেকে প্রেরণা না পেয়ে থাকেন, তাহলে কার কী করার আছে?

৪.

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন কি না তা নিয়েও একে খন্দকার প্রশ্ন তুলেছেন। বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একটি রায়ের মাধ্যমে নিস্পত্তি করা হয়েছে। আদালতের রায়ে মীমাংসিত একটি বিষয় নিয়ে অহেতুক বিতর্কের প্রয়োজন নেই বলেই মনে করি। যে দলিল দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছে সেটার সত্য মিথ্যা নিয়ে অপ্রয়োজনীয় তর্ক করে সময় নষ্ট না করাই উচিত। এখানে বরং বিতর্ক হতে পারে অন্য ব্যাপারে; আদালতের রায়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ও সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত একটি বিষয় নিয়ে এভাবে প্রশ্ন তোলাটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে কি না সেটাই বরং আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত।

আমরা আপাতত অন্য একটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দিই। একে খন্দকার লিখেছেন, ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল এবং না গিয়ে তিনি ক্ষতি করেছেন। কী হলে কী হতে পারত তা নিয়ে আসলে অনন্তকাল তর্ক করা সম্ভব, তাতে কাজের কাজ কিছু হবে না। বঙ্গবন্ধুর কাছে যা ভালো মনে হয়েছে তিনি তা করেছেন, একে খন্দকার সেটা স্বীকারও করেছেন এবং স্বীকার করেই ঠিক তার পরের অনুচ্ছেদের আবার একই মায়াকান্না জুড়েছেন।

যাহোক, বঙ্গবন্ধুর মতো পোড় খাওয়া রাজনীতিক হাতে কোনো বিকল্প না রেখেই কাজ করেছেন এটা মোটামুটি অসম্ভব ব্যাপার। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার জন্য অপেক্ষা করা ছড়াও আরও পরিকল্পনা তার ছিল। তার অন্তত একটির সাক্ষ্য দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর প্রতিবেশি নয়ীম গহর। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা: ফ্যাক্টস অ্যান্ড উইটনেস’ বইয়ে নয়ীম গহরের জবানিতে সেই কথা জানাচ্ছেন আ ফ ম সাঈদ–

“বঙ্গবন্ধু কেন চট্টগ্রামে এম আর সিদ্দিকীর কাছে যুদ্ধ শুরুর নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। হ্যাঁ, কথা ছিল চট্টগ্রাম থেকেই যুদ্ধটা শুরু হবে এবং তার নেতৃত্বে থাকবেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। কিন্তু পাকিস্তানি আর্মি ইন্টেলিজেন্সের গোপন একটি তথ্য ঠিক সময়মতোই জানতে পারে যে, শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রামে যাওয়ার চেষ্টা করলেই যেভাবেই হোক তাকে পাকিস্তানি আর্মি মেরে ফেলবে এবং সম্ভাব্য হত্যা করার জায়গাটি ছিল কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের কাছাকাছি। [৪]”

২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল এবং না গিয়ে তিনি ক্ষতি করেছেন

একে খন্দকার আরও বলেছেন, গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে তিনি কোনো নির্দেশ দিয়ে যাননি। বঙ্গবন্ধুর জায়গা থেকে সেই সময় জনে জনে নির্দেশ দিয়ে যাওয়া নিশ্চয়ই সম্ভব ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীসহ অনেকেই ধানমণ্ডিতে তাঁর বাসায় ছিলেন এবং তাদেরকে বিভিন্ন রকম পরামর্শই বঙ্গবন্ধু দিয়ে গেছেন। এত বিশাল একটা যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে, কত দিন সেটা চলবে কেউ জানে না, আর সেই ব্যাপারে সব রকম নির্দেশনা ঘরে বসেই মুজিব দিয়ে যাবেন এটা যদি কেউ আশা করে থাকে তাহলে সেটা মারাত্মক ভুল।

একে খন্দকারও সেই আশা করেননি। এখন পাঠককে বিভ্রান্ত করার জন্যই এইসব বলছেন তিনি। যাহোক, নয়ীম গহরের ভাষ্য থেকেই আমরা জানতে পারছি, যুদ্ধ কীভাবে শুরু করতে হবে সেই ব্যাপার গ্রেফতার হওয়ার আগেই চট্টগ্রামে এম আর সিদ্দিকী ও ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেনকে অভিন্ন একটি বার্তা আলাদাভাবে পৌঁছে দেন। নির্দেশনাগুলো ছিল-–

  1. Talk has failed
  2. Don’t surrender Arms (EPR, EBR, Police, Ansar and general people)
  3. Let the people and other start…
  4. Liberate Chittagong
  5. Proceed toward Comilla
  6. Carry out my earlier orders even if I am not available (dead or a captive)
  7. Confirm me back that Chittagong understood me clearly[৪]

এই মেসেজের অর্থ, যুদ্ধ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব পরিকল্পনা ছিল এবং এ ব্যাপারে আগে থেকেও নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। একে খন্দকারের দাবির যৌক্তিকতা তাহলে ধোপে টিকছে না।

একে খন্দকার বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে একটি বেশ গর্হিত মন্তব্যই করেছেন বলা যায়, শেখ মুজিব নাকি মার্চে ইয়াহিয়ার সঙ্গে বসে বসে ভিন্ন রাজনৈতিক খেলা খেলছিলেন। যাহোক, এই ব্যাপারেও বেশি কিছু বলার নেই, কোনটা কার কাছে খেলা মনে হবে সেটা নিয়ে অন্য কারও কিছু বলার থাকতে পারে না। শুধু দুটি কথোপকথনের উদ্ধৃতি দিয়ে এই অংশটুকু শেষ করতে চাই। আলোচনা যখন চলছে, তার মাঝেই ১৭ মার্চ ইয়াহিয়া খান টিক্কা খানকে মুজিব সম্পর্কে বলেছে, ‘দ্যা বাস্টার্ড ইজ নট বিহ্যাভিং, ইউ গেট রেডি’। [৫]

মুজিব ঠিক কী চাচ্ছিলেন যার জন্য ইয়াহিয়া এই উক্তি করেছেন, তার নমুনা পাওয়া যাচ্ছে মার্চের ২৫ তারিখে করা জুলফিকার আলী ভুট্টোর উক্তিতে–

২৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে ভুট্টো বললেন, ‘পরিস্থিতি অত্যন্ত আশংকাজনক’। তিনি সাংবাদিকদের আরও বললেন– ‘আওয়ামী লীগ যে ধরনের স্বায়ত্তশাসন চাচ্ছে তাকে আর স্বায়ত্তশাসন বলা যায় না। ওদের দাবি তো স্বায়ত্তশাসনের চেয়েও বেশি’। [৫]

এই প্রসঙ্গে এর বেশি আর কিছু আলোচনার দরকার আছে বলে মনে হয় না।

৫.

সামরিক বাহিনীর বাইরে থেকে আসা গেরিলা যোদ্ধাদের নিয়ে কয়েকটি অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন একে খন্দকার। যুদ্ধের সময় সময়ে ভারতের কাছ থেকে পাওয়া সামরিক সহযোগিতা নিয়েও কটূক্তি আছে বইয়ে। গেরিলা যোদ্ধাদের কৌশল ও অনভিজ্ঞতা নিয়ে একে খন্দকার যা বলেছেন তা যে কোনো বিচারেই অশালীন। তার মনে রাখা উচিত, বহু সেনাসদস্য যখন ইতস্তত করছিলেন তখন এইসব বেসামরিক তরুণরাই ঘর-পরিবারের মায়া কেটে যুদ্ধে যোগ দিতে ছুটে এসেছে। কী দিয়ে লড়াই করবে সে সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান না থাকলেও লড়তে হবে এই বোধটুকু তাদের ছিল; কারণ তারা চোখের সামনেই নিজের ভাই-বোন-বাবা-মাকে মরতে দেখে এসেছে।

একটি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম কখনও-ই শতভাগ সামরিক বাহিনীর উপর নির্ভর করে পরিচালনা করা সম্ভব নয়, তাকে একটি কার্যকর গণযুদ্ধে রূপান্তরিত না করতে পারলে সেই যুদ্ধে সাফল্য পাওয়া অসম্ভব। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই সব সাধারণ মানুষদের সামান্য ট্রেনিং দিয়ে গেরিলায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। অদক্ষতা এবং অনভিজ্ঞতা তাদের অন্যতম প্রধান শত্রু ছিল, এতে দ্বিমত নেই কারও; তবে সেই সঙ্গে এ-ও সত্য এই অনভিজ্ঞ গেরিলারাই কিন্তু বহু সফল অভিযানের নায়ক। একে খন্দকার গেরিলাদের ব্যর্থতার কথা এনেছেন। সামরিক বাহিনী থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধারাও কি এসব ব্যর্থতা থেকে মুক্ত ছিলেন? তিনি নিজে তো সম্মুখ সমরে যাননি, যারা গিয়েছেন তাদের অবদান খাটো করার এই মানসিকতা একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে তিনি কীভাবে ধারণ করেন?

একে খন্দকার লিখেছেন, প্রয়োজনীয় অস্ত্র দিতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনীহার কথা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভারতের তখনকার মানসিকতা নিয়েও কয়েকটি মন্তব্য করেছেন। শুনতে রূঢ় মনে হলেও, ভারত নিশ্চয়ই তখন আমাদের জন্য নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে দেবে না। যুদ্ধটা বাংলাদেশের, ভারতের নয়। কাজেই সেই যুদ্ধে সহযোগিতা করতে গিয়ে তাদের কতটুকু ক্ষতি হচ্ছে সেটা অবশ্যই ভারতকে হিসাব করতে হবে।

যুদ্ধের সেই দশটি মাস এবং তার পরেও এক কোটির বেশি শরণার্থীর প্রত্যেকে লাশ হয়ে যেত যদি ভারত সহযোগিতা না করত। ভারতের নিজস্ব সেনাবাহিনী আছে, নিজেদের প্রতিরক্ষা নিয়েও তাদের দুশ্চিন্তা আছে। সেইসব বাদ দিয়ে, কেন ২০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ গোলাবারুদ দেওয়া হচ্ছে এটা নিয়ে অনুযোগ করাটা খুবই অশ্লীল শোনায়।

বাঙালিরা বিহারি হত্যা করেছে, লিখেছেন একে খন্দকার। বিহারিদের সম্পত্তি লুটপাট করা হয়েছে। অথচ যুদ্ধ শুরুর আগেই পরিকল্পিতভাবে বিহারিদের বাঙালি নিধনে লেলিয়ে দেওয়াটা তার চোখে পড়ল না? কিছু মানুষ পরিস্থিতির সুযোগ নেবেই, তাতে নিরপরাধ বিহারিদের প্রাণও গিয়েছে। কিন্তু এই বিহারিরাই যে দু’দিন আগেই এই বাঙালিদের স্বজনদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে সেটা এড়িয়ে একে খন্দকার যেভাবে সরলীকৃত বক্তব্য দিলেন সেটা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

একে খন্দকার লিখেছেন প্রয়োজনীয় অস্ত্র দিতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনীহার কথা

৬.

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে আমাদের জন্য হতাশাজনক ব্যাপার হল, ইতিহাসের ভুল ও বিভ্রান্তিকর সংস্করণ প্রকাশের সেই মিছিলে শামিল হয়েছেন স্বয়ং মুক্তিযোদ্ধারাই। প্রথমা প্রকাশনী এই ধরনের মিথ্যাচার প্রকাশ করার দায়িত্বটা পালন করে চলছে অনেক দিন আগে থেকেই। এই প্রথমা থেকেই প্রকাশিত গোলাম মুরশিদের ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর: একটি নির্দলীয় ইতিহাস’ বইয়ে মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে এত বছর পরে সংশয় তোলা হয়েছে।। তার ধারাবাহিকতা হিসেবে এবার এল ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’। প্রশ্ন হচ্ছে, কার স্বার্থে এই বিকৃতি?

এর উত্তর সহজ, আবার কঠিন। সহজ উত্তরটি হচ্ছে, অবশ্যই বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের স্বার্থেই এসব হয়ে চলেছে। আবার আরও একটু কঠিন করে জিজ্ঞেস করা যায়, এসবের উদ্দেশ্য কী? এসব কি কোনো দীর্ঘমেয়াদী ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের আলামত? অন্য কোনো ষড়যন্ত্র থেকে চোখ ঘুরিয়ে রাখতে ডাইভারসন? এই ব্যাপারগুলোর তদন্ত হওয়া উচিত।

এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা হল ইতিহাস বিকৃতি রোধে কঠোর আইন এবং তার আরও কঠোর প্রয়োগ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জেনোসাইড ডিনায়াল শাস্তিযোগ্য অপরাধ, একইভাবে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যে কোনো বিকৃতি ও মিথ্যাচার কঠোর শাস্তির উপযুক্ত অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে আইন তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা, উপাত্ত, দলিল আর প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের দিকে নজর দিতে হবে বিশেষভাবে। না হলে দুই দিন পর পর এমন আকাশ থেকে পড়া ইতিহাসের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এই পৌনঃপুনিক বিকৃতি চিরতরে বন্ধ হোক।

প্রীতম দাস: তড়িৎ প্রকৌশলী। ব্লগার, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় উৎসাহী।

তথ্যসূত্র:

১. ১৯৭১ উত্তর রণাঙ্গনে বিজয়, আখতারুজ্জামান মন্ডল

২. A Tale of Millions, Rafikul Islam BU

৩. ‘মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দার ও তার বিয়োগান্ত বিদায়, জহিরুল ইসলাম

৪. বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ফ্যাক্টস অ্যান্ড উইটনেস, আ. ফ. ম. সাঈদ

৫. একাত্তরে বন্দী মুজিব পাকিস্তানের মৃত্যুযন্ত্রণা, অধ্যাপক আবু সাঈদ।

প্রথম প্রকাশ: মতামত-বিশ্লেষণ, bdnewes24.com

পোস্ট কিংবা মন্তব্যে প্রকাশিত বক্তব্য কোন অবস্থাতেই আইসিএসএফ এর নিজস্ব মতামতের বা অবস্থানের পরিচায়ক নয়। বক্তব্যের দায়ভার লেখক এবং মন্তব্যকারীর নিজের। শুধুমাত্র আইসিএসএফ নামের আওতায় প্রকাশিত বক্তব্যই ব্লগের সামষ্টিক অবস্থানকে নির্দেশ করবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Comments

comments

Archive I: Media Archive

Archives news reports, opinions, editorials published in different media outlets from around the world on 1971, International Crimes Tribunal and the justice process.

Archive II: ICT Documentation

For the sake of ICT’s legacy this documentation project archives, and preserves proceeding-documents, e.g., judgments, orders, petitions, timelines.

Archive III: E-Library

Brings at fingertips academic materials in the areas of law, politics, and history to facilitate serious research on 1971, Bangladesh, ICT and international justice.

Archive IV: Memories

This archive records from memory the nine-month history of 1971 as experienced and perceived by individuals from all walks of life.