২০১২ সালের ২৭শে নভেম্বরের কথা হয়ত অনেকদিন মনে রাখবেন লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টারে আসা হাজারো দর্শনার্থী, পথিক, অফিসযাত্রী, সাধারণ নাগরিক কিংবা বাসে, ট্রামে, গাড়িতে, থাকা নাম না জানা অসংখ্য মানুষেরা। কেননা সেদিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অফিস, ১০ নাম্বার ডাউনিং স্ট্রীটের বাইরে ঢল নেমেছিলো হাজারো মুক্তপ্রাণ বাঙালীর। স্লোগানে, প্ল্যাকার্ডে, ব্যানারে, হাতে হাত ধরে, গানে, কবিতায়, তাঁরা উচ্চকিত হয়েছেন বাংলাদেশে বর্তমান চলতে থাকা ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের’ জন্য বিশ্ববাসীর সমর্থন আদায়ের জন্য। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লক্ষ কিংবা তারো অধিক নিরপরাধ মানুষ খুন হয় এবং ৪ লক্ষ কিংবা তারও অধিক নারী পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের এই দেশীয় দোসরদের হাতে নির্যাতিত ও নিগৃহীত হয় এবং হয়তো জানেন এদের কৃত অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ শে মার্চে গঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল। কিন্তু এই ট্রাইবুনাল যাতে সঠিক ভাবে চলতে না পারে, সঠিক ভাবে বিচার না হতে পারে এবং এই বিচার প্রক্রিয়া যাতে সারা পৃথিবীর সামনে হেয় কিংবা খেলো প্রতিপন্ন করে তোলা যায় সে কারনে চিহ্নিত স্বাধীনতা বিরোধীরা গত ৩ টি বছর ধরেই নানাবিধ মিথ্যের বেসাতি চালিয়ে আসছিলো, বিশ্ববাসী এবং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত করে ক্রমাগত। কিন্তু আপামর জনসাধারণের অনন্য সমর্থনে এই ট্রাইবুনাল বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে, পৃথিবীর সকল ট্রাইবুনালের মধ্যে অনন্য এক বিচার ব্যাবস্থা হিসেবে এগিয়ে চলছে। এই এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে পুরো পৃথিবীর সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই বিচারের জন্য আরো সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে হাজার হাজার মানুষ লন্ডনে একত্রিত হয়ে মানব বন্ধনের আয়োজন করেছেন গত মঙ্গলবার (২৭ শে নেভম্বর ২০১২)। এই মানব বন্ধনে মূলত লন্ডনের সকল মুক্তপ্রাণ মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে যান ওয়েস্টমিনিস্টারের ব্যাস্ত রাস্তায়। এক মানব বন্ধনে অনেক সংগঠনের ব্যানারে তারা একত্রিত হন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে দলীয় ব্যানার ছাড়া তাঁরা আসতেন না। অনেকেই অনেক দল সমর্থন করেন কিংবা দলের কাজের সাথে রয়েছেন, সে কারনেই এই আয়োজনে সেই সকল সংগঠনের সাথে তারে এসেছেন। এদের মধ্যে রয়েছে, ইন্টারন্যশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম, উদীচি শিল্পীগোষ্ঠী, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, প্রজন্ম একাত্তর, জাসদ, ফ্রেন্ডস অফ ছাত্র ইউনিয়ন, কর্ণেল তাহের পরিষদ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের বিবিধ অঙ্গ-সংগঠন সহ আরো অনেক দল।
এইদিন লন্ডনে সকাল থেকেই অত্যন্ত দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ছিলো। লন্ডনের সেই চিরাচরিত ঝিরঝিরে বৃষ্টি, দমকা বাতাস, সব কিছু মিলিয়ে বেশ বৈরী আবাহাওয়া থাকলেও এ সব কিছুই উপেক্ষিত হয়েছে মুক্তপ্রাণ মানুষের দেশের প্রতি এক তীব্র ভালোবাসার কাছে। দেশের টানে, ৩০ লক্ষ শহীদের ঋণ শোধ করবার সামান্য চেষ্টাটুকুও কেও হেলায় হারাতে চান নি। লন্ডনের কর্মব্যাস্ত জীবনের সকল ঝক্কি, বাধা উপেক্ষা করে তাঁরা এসেছেন মানুষের স্রোতে। কেউ এসেছেন কাজ ফেলে, কেউবা কাজ করবেন না বলেই জানিয়ে দিয়েছেন, কেউবা এসেছেন হাসপাতালে প্রিয়জনকে রেখে, পরিবার, পরিজন ব্যাবসা সব কিছু ফেলে। এসে স্লোগান তুলেছেন বিচারের। তাঁরা জানিয়েছেন একাত্তরে যারা প্রাণ দিয়েছেন, যারা নির্যাতিত হয়েছেন তারাই মূল ভিক্টিম, তাঁরাই বিচারের প্রাপ্য, মানবাধিকারের যোগ্য দাবীদার, তাঁদের উপর হওয়া অকথ্য নির্যাতনের বিচার না হলে বাংলাদেশে আজীবন এক অভিশাপের কক্ষপথেই ঘুরতে থাকবে। সামনে এগুবে না। গানে গানে, স্লোগানে স্লোগানে তাঁরা মাতিয়েছেন ব্যাস্ত রাজপথ, ব্যাস্ত জনপদ। মানুষের স্রোত প্রাণে প্রাণে মিলেছিলো, কন্ঠ মিলেছিলো আরেক কন্ঠের সাথে, হাতের স্পর্শ লেগেছে অন্য হাতে। এইসব প্রাণের দাবী গর্জন হয়ে লন্ডনের আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছিলো সেদিন যে, বাংলাদেশে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল চলবে, বিচার হতেই হবে এবং এই বিচার প্রক্রিয়ায় সকলকেই চাই আমাদের পাশে, আমাদের সাথে।
FB Photo Album: https://www.facebook.com/media/set/?set=a.451581421566110.108252.108286975895558&type=3